‘প্রথম শ্রেণির’ পৌরসভা, তৃতীয় শ্রেণির বাস্তবতা

তিন দশকেরও বেশি সময় আগে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হলেও বাস্তবে নওগাঁ শহরের চিত্র এখনও যেন মফস্বলেরও নিচে। রাস্তাঘাটের বেহাল দশা, বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা, অচল ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও অপ্রতুল নাগরিক সেবার কারণে দুই লাখ জনগণের এই শহরে প্রতিদিনের জীবন এক আতঙ্কের নাম।
একটানা ১০ মিনিট বৃষ্টি হলেই শহরের গুরুত্বপূর্ণ সিও অফিস থেকে চকবাড়িয়া সড়ক হাঁটু পানি আর কাদায় ডুবে যায়। সেই পানি নামতে লাগে প্রায় ১০ দিন। পানি নিষ্কাশনের কোনো পরিকল্পিত ব্যবস্থা না থাকায় ময়লা-আবর্জনা আর পয়ঃবর্জ্যে পুরো শহর হয়ে পড়ে একাকার। ফলে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানাবিধ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশু-কিশোররা।
নওগাঁ পৌরসভার আওতায় থাকা প্রায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে ১০০ কিলোমিটার এখনও কাঁচা এবং ৮০ শতাংশ রাস্তাই চলাচলের অযোগ্য ও খানাখন্দে ভরা। শহরের গুরুত্বপূর্ন সড়কগুলো চকবাড়িয়া থেকে দুর্গাপুর, দয়ালের মোড়, তাজের মোড়, ছুটি কালীতলা, পালপাড়া, গোস্তহাটির মোড়, উকিলপাড়া সবখানেই একই চিত্র।
চকবাড়িয়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রহিম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, "রাস্তাগুলো ১৫ বছরেও সংস্কার হয়নি। বর্ষায় হাঁটাও যায় না। এখানে শহরের চেহারাই নেই এ যেন কাদায় ডোবা জনপদ।"
সিও অফিস এলাকার বাসিন্দা উজ্জল কুমার বলেন, "তিন চাকার অবৈধ অটোরিকশা শহরকে অচল করে ফেলেছে। শহরের চেয়ে বেশি দেখি গাড়ি। যানজটে স্কুলে বাচ্চাদের সময়মতো পৌঁছানো যায় না।"
নওগাঁ পৌরসভা সূত্রে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে স্থাপিত নওগাঁ পৌরসভা ১৯৮০ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে এবং ১৯৮৯ সালে প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হয়। প্রায় ৩৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের পৌরসভাটির বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় দুই লাখ। শহরের প্রায় ৩০০ কিলোমিটার রাস্তার মধ্যে প্রধান সড়কের সংখ্যা ২০টি। এরমধ্যে পাকা রাস্তার হয়েছে ১৫০ কিলোমিটার আধা পাকা রয়েছে ৫০ কিলোমিটার এবং কাঁচা রাস্তা ১০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ রাস্তা চলাচলের অযোগ্য ও খানাখন্দে ভরা।
নগরের অপরিকল্পিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং জলাবদ্ধতা কেবল চলাচলই নয়, জনস্বাস্থ্যকেও ঝুঁকির মুখে ফেলছে। প্রশিকা বিদ্যানিকেতনের শিক্ষিকা মৌসুমী বলেন, "সড়কে হাঁটতে গেলেই ময়লার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে। দিন-রাতের ২৪ঘন্টায় শহরটি এখন মশা-মাছির দখলে। এ শহরে থাকাটাই এখন কষ্টকর।"
পৌরসভার অব্যবস্থাপনা ও অকার্যকর সেবায় হতাশ নাগরিকরা বলছেন, কাগজে কলমে প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হলেও বাস্তবে এটি যেন পরিত্যক্ত এক জনপদ। অ্যাডভোকেট আব্দুস সামাদ বলেন, "এ শহরের কোনো অভিভাবক আছে বলেই মনে হয় না। যত্রতত্র গাড়ি, দুর্গন্ধ, পানি সবমিলিয়ে আমরা যেন বন্দি।"
নওগাঁ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানিয়েছেন, আপাতত তিনটি রুট তাজের মোড় থেকে ছুটি কালীতলা, গোস্তহাটির মোড় থেকে শাহী মসজিদ ও নাপিতপাড়া পর্যন্ত সড়কের জন্য ১৯ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। বাকি সড়কের উন্নয়নের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
তিনি বলেন, "সমস্যাগুলো দীর্ঘদিনের, হুট করে সমাধান সম্ভব না। তবে আমরা পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে চাই।"
অবাক করা বিষয় হলো, নওগাঁ পৌরসভা সেবা দিতে ব্যর্থ হলেও ২০২৫ সালের ১ জুলাই থেকে হোল্ডিং ট্যাক্স ও পানি বিল বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। পৌরসভার প্রশাসক টি.এম.এ. মমিন জানান, "নতুন হার অনুযায়ী রাজস্ব আদায় কার্যকর হচ্ছে ১ জুলাই থেকে। আর পৌরসভার উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে।" তবে স্থানীয়দের প্রশ্ন যেখানে বিদ্যমান সড়ক-ময়লা-পানি সমস্যা বছরের পর বছর ধরে রয়েছে, সেখানে কর বাড়িয়ে এই সমস্যার সমাধান কীভাবে হবে?
নওগাঁবাসীর চাওয়া খুব বেশি নয় তারা শুধু আধুনিক নাগরিক সুবিধা চান, যা তাদের প্রাপ্য। পানিনিষ্কাশন, সড়ক মেরামত, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা না নিলে নওগাঁ শহর হয়তো নামেই 'প্রথম শ্রেণির' রয়ে যাবে, বাস্তবে নয়।
Comments