'মেমরি লেন' কিংবা 'স্মৃতিমেধ' কথা...!

স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে বইয়ের প্রথম পাতাটা উল্টাতেই আমি থেমে যাই!...থমকে যাই!
'উৎসর্গ পাতায়' ছাপার অক্ষরে স্ত্রী এবং আমার নামের দিকে অবাক, বিস্মিত তাকিয়ে থাকি!
এমন অবাক আমি আরও একবার হয়েছিলাম!
ছয় বছর আগে!
সেদিনও ফেব্রুয়ারীর এমনই এক মায়াবী বিকেলে ছোট ভাই গিয়াস আহমেদ আমার হাতে তুলে দিয়েছিলো 'কুহকের দিনরাত্রি' নামের একটা বই!
বইয়ের নামের নিচে ছোট ছাপার অক্ষরে আমারই নাম। অথচ তখনও আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না। এবারও ঠিক তাই। এই 'উৎসর্গ' বিষয়ে আমার কিছুই জানা নেই!
হায়! যদি জানতাম।
ভালো লাগার শুরুটা বইয়ের ওই প্রথম পাতা থেকেই। সহসাই পদচ্যুত একজন ক্ষমতাধর (টেকনোক্রেট মন্ত্রী) মানুষ; যার হাতে এখন অখণ্ড অবসর...যিনি এখন ঘোরগ্রস্তের মতো যখন-তখন হাঁটছেন তার 'মেমোরি লেনে'। ফিরে ফিরে দেখছেন ফেলে আসা জীবন; কখনও আফসোসে বিচলিত; কখনও আত্মগ্লানিতে বিদগ্ধ ! কখনও বা তার শূন্য-সংসারে নিরব হাহাকার তুলছেন প্রবাসী একমাত্র কন্যার জন্য। যাদের তিনি একদা সময়ই দিতে পারতেন না; এখন নিজেই তাদের খুঁজে খুঁজে ফেরেন। তার এখন বড় নিঃসঙ্গ, একাকী জীবন। আর এমন একটা বইই উৎসর্গ করা হয়েছে আমার মতো আর এক অবসরপ্রাপ্ত মানুষকে। পথ ভিন্ন হলেও গন্তব্যতো সবার একই। পড়তে গিয়ে আমিও যেন সেই মানুষটার সাথে বেশ আগ্রহ নিয়েই তার 'মেমরি লেনে' ঢুকে পড়ি!
এবং কিছুদূর যাবার পরই আমি আবারও থমকে যাই! চমকে যাই!
অবসর জীবনে 'ইয়া সিন আলি (বানানটা তিনি এভাবেই ভেঙে লেখেন)' নামের এই মানুষটা মোবাইল হাতে যাকে প্রথম কলটা দিয়েছেন;
আমি তাঁকে চিনি। গভীরভাবেই চিনি। তাঁর সাথে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। করোনার সেই দুঃসহকালে কাছাকাছি থেকে তাঁকে চিনেছি আরও ঘনিষ্ট এবং বিষদভাবে। তিনি 'কমান্ডার মো. সোলায়মান'। লেখকের সাথে এই মানুষটার পরিচয় সামান্যই। অথচ কী দারুণ দক্ষতায় এবং কী নিপুণভাবেই না তিনি মানুষটিকে তার বইয়ে তুলে এনেছেন। আমাকে 'উৎসর্গ' সম্পর্কে যদি ঘুনাক্ষরেও আগে থেকে জানতাম। এই মানুষটিকেই বইটি উৎসর্গ করার আমি অনুরোধ জানাতাম। যদি বইটি তার হাতে তুলে দিতে পারতাম, যদি পারতাম তাঁকে নিয়ে এই অংশটুকু পাশে বসে নিজে পড়ে শুনাতে; নিশ্চয়ই তিনি খুব খুশি হতেন। কিন্তু তা আর হবার নয়। তিনি এখন জাগতিক সব খুশি-অখুশির উর্ধ্বে। মূলত বইয়ের এই জায়গা থেকেই আমাকে আর থামতে হয়নি; প্রথম দিকে গতি কিছুটা স্লথ হলেও এখান থেকেই আমি হেঁটে গেছি একটানা। আমার বিশ্বাস,আপনাদেরও তেমনই হবে। এই ভ্রমণে আমি কখনও আনন্দে হেসেছি, কখনো বেদনায় ডুবেছি। ক্ষনে ক্ষনে মনে হয়েছে এ কাহিনীতো আমারই। এদের সবাইইতো আমার পরিচিত!... ভীষণ পরিচিত। সেই যে ছোট্ট মেয়েটি; কথা শেষ করেই যে টেনে টেনে বলে 'বু-ঝে-ছো'?
সেই 'মধু ফুম্মা', আবু তালেব কাকা, ডাবল এম.এ. হেডমাস্টার গোলাম মোস্তফা (বিনাপয়সায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা দেওয়া যার নেশা!), বশির মাস্টার, শেখ রাজ্জাক, সুলতানা রাজিয়া, আর হেমন্তের সেই ধূসর সন্ধ্যায় নিভু নিভু খড়ের আগুন, ধোঁয়া জড়ানো কুয়াশা'। এসবই যে আমার বড় চেনা। আমাকে বড় আকুল-ব্যকুল, স্মৃতিকাতর করে দেয়। আর বাড়ির পাশের কালিগঙ্গা নামের ছোট্ট খালের ওপারের সেই যে 'কুসুম আপা'। স্মৃতিকে তিনি 'মেধ' করেছেন দারুণ দক্ষতা আর পরিমিতি বোধে। পড়তে গিয়ে সত্যিই কখনও কখনও হৃদয়ে হয়েছে রক্তক্ষরণ। মাত্র দু'টি লাইনেই তিনি 'কুসুম আপা'র যে পরিণতি টেনেছেন। যে হাহাকার ছড়িয়েছেন। বুক দুমড়ে-মুচড়ে উঠে! চোখ ভিজে যায়। 'সুলতানা রাজিয়া বানু'র বিষয়টাও বেশ হৃদয়স্পর্শী এবং কৌতূহলোদ্দীপকও বটে!
শেষ দিকে কাহিনীকে তিনি বেশ দক্ষতার সাথেই টুইস্ট করেছেন!
আমার মনে হয়, 'আমার নাম থেকে তুমি মেয়ের নাম রেখেছো সুলতা। কেন? সুলতানা'র এমন প্রশ্নের উত্তরে ইয়া সিন সাহেব ব্যাখ্যায় না গিয়ে একধরনের অসহায়-নিরবতা দেখালেই হয়তো ভালো হ'ত! (একান্তই আমার নিজস্ব উপলব্ধি!) ছোট্ট একটা বই। অথচ কী তার ব্যাপ্তি। কতো কতো ঘটনা, কতো চরিত্র। এখানে এসেছে 'পাওয়ার পলিটিক্সের কথা, ক্ষমতাধর 'সুপ্রিমো'র কথা। ...এসেছে রাজনীতির 'সাপলুডু' খেলার বিষয়ও। অকেজো হয়ে পড়া 'টেলিফোন ডাইরেক্টরি', 'টেলিফোন ইনডেক্স, 'ধানিরঙা চিঠির খাম',--এসব প্রসঙ্গ এনে তিনি দারুণ এক স্মৃতিকাতরতা তৈরি করেছেন। ক্ষমতা থেকে সরে আসার পর আর 'মুহুর্মুহু বেজে না উঠা' ল্যান্ডফোন, ঢাউস টেলিফোন ডিরেক্টরি। এসবের দিকে তাকিয়ে তার যে আত্মোপলব্ধি; অসাধারণ! বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ক্যারেক্টরের বইটি এখন ফেলনা। তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে! জগত ও জীবনে যার কোন কাম নেই, তার আর দামও নেই...। যেমন তিনি।"
এ উপলব্ধি বড় মর্মদায়ক! এ বইয়ে যেমন আছে সমাজের উচুতলার(!) 'কমিশন খান', 'বোতল সাহেব' আর 'পানি পথের নিয়মিত পথিক (পান প্রসঙ্গে এই শব্দের এমন ব্যবহার মনে হয় এই প্রথম!)দের ধূর্ততার কথা; তেমনি আছে 'নিচু-তলা'র মানুষ রমা আর হারাণের মা'র সরলতা আর নির্ভেজাল আন্তরিকতার কথাও।
আছে স্কুলবন্ধু,তালপাতার ঘড়ি, পিতলের পানের বাটা!!.....
ধূমপানের(সিগারেট পোড়ানো!) মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাসহ আরও কতো কী! আর সেইসাথে আছে বইয়ের চকচকে নান্দনিক প্রচ্ছদ; ঝকঝকে ছাপা (দু'একটা মুদ্রণত্রুটি বাদে)। আর আছে এর চমৎকার 'গীতল' ভাষা। কী নেই তবে এ বইয়ে? বইয়ের নাম 'হ্যালো, কেমন আছো' প্রশ্নটা সহজ। কিন্তু ...!
Comments