রায়ের আড়ালে বন্দরের ভবিষ্যৎ: লালদিয়া–পানগাঁও চুক্তিতে গণস্বার্থ কি উপেক্ষিত?
১৭ নভেম্বরের দিনটি জাতীয় রাজনীতিতে ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে রায় ঘোষণার কারণে দেশের মানুষের পুরো নজর ছিল বিচারাঙ্গনে। মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া - সব আলোচনার কেন্দ্র সেই রায়। এমনই একটি আলোচিত দিনকে বেছে নিয়ে সরকার দেশের দুটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর অবকাঠামো বিদেশি অপারেটরদের কাছে দীর্ঘমেয়াদি লিজে তুলে দিল। ঘটনাটির সময়সূত্র অনেকের কাছেই সন্দেহজনক মনে হয়েছে - কারণ এই আলোচনার মাঝেই দেশের অর্থনীতি ও বন্দরব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণকারী সিদ্ধান্ত চুপিসারে বাস্তবায়িত হলো।
চুক্তি দুটি হলো - চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল ডেনমার্কের এপি মোলার-মায়েরস্কের সহায়ক প্রতিষ্ঠান এপিএম টার্মিনালসকে ৩০ বছরের জন্য হস্তান্তর; এবং ঢাকার নিকটবর্তী পানগাঁও নদীবন্দর সুইজারল্যান্ডের মেডলগকে ২২ বছরের জন্য পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া। এপিএম টার্মিনালস তিন বছরে বিনিয়োগ করবে ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, আর মেডলগ দেবে ৪০০ কোটি টাকার মতো।
এত বড়ো অবকাঠামো - যা মূলত দেশের সমগ্র আমদানি-রপ্তানি প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে - তা প্রথমবারের মতো বিদেশি অপারেটরদের হাতে তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু তা হওয়ার পরপরই ওঠে স্বচ্ছতার প্রশ্ন। কারণ সরকার চুক্তির একটি ধারাও প্রকাশ করেনি। দরপত্র বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, লালদিয়া প্রকল্পে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। ফলে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬ ও বিধিমালা ২০০৮ - দুটিই লঙ্ঘিত হয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে - বন্দর অবকাঠামো কি এতটাই জরুরিভাবে বিদেশিদের হাতে দিতে হলো, যে দরপত্র পর্যন্ত করা হলো না? নাকি কোনো লাভের অঙ্ক জনসমক্ষে আসুক, সরকার তা চায়নি?
একটি বড়ো প্রশ্ন অর্থনৈতিক দিক থেকেও উঠে আসে : বাংলাদেশ যদি চাইত, এই ৬ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ নিজেই করতে পারত। এতে পরিচালনকালীন পুরো মাশুলই দেশে আসত। এখন বিদেশি অপারেটর মাশুল আদায় করবে ৩০+১৫ বছর পর্যন্ত। বাংলাদেশের ভাগ কত - এটিও জনগণের সামনে আনা হয়নি। এত বড়ো আর্থিক অংশীদারিত্ব কীভাবে গোপন রাখা হয়— জনগণ এটিকে হজম করতে পারছে না।
এ ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে এই ধরনের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি কতটা যুক্তিসঙ্গত - এ প্রশ্নও উঠেছে। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ স্পষ্ট করে বলেছেন, এটি অন্তর্বর্তী সরকারের ম্যান্ডেটের বাইরে। তার ভাষায়, গোপনীয়তা, অস্বচ্ছতা আর অযথা তাড়াহুড়ার মধ্য দিয়ে এ চুক্তি করা হয়েছে এবং ইতিহাসে এটি বিশ্বাসঘাতকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে নথিবদ্ধ থাকবে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামানও একই উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। দেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু চট্টগ্রাম বন্দর - সেখানে কার সঙ্গে কী ধরনের চুক্তি হচ্ছে, সে বিষয়ে জনগণের জানার অধিকার আছে। কিন্তু সরকার সেই অধিকার বঞ্চিত করেছে।
সব মিলিয়ে প্রশ্নগুলো ঘনীভূত হচ্ছে -
• কেন এত অস্বচ্ছভাবে চুক্তি হলো?
• কেন এত তাড়াহুড়ো?
• কেন ঠিক এমন একটি রাজনৈতিক উত্তেজনার দিনে স্বাক্ষর করা হলো?
• আর জনগণের লাভ-ক্ষতির হিসাব কেন গোপন?
বন্দরের নিয়ন্ত্রণ জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনীতির সবচেয়ে কৌশলগত জায়গা। তাই এমন সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, গণআলোচনা থাকা জরুরি। কিন্তু এই চুক্তি যেন উল্টো দিকেই হাঁটল—এটি মানুষের মনে গভীর সন্দেহ তৈরি করেছে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব, নীতিনির্ধারণের স্বচ্ছতা এবং জনআস্থা - সবকিছুই এখন এই চুক্তির সামনে চ্যালেঞ্জের মুখে।
Comments