আর্থিক খাতে বিপ্লব ঘটাতে আসছে ডিজিটাল ব্যাংক

বাংলাদেশের আর্থিক খাতে এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংকের মাধ্যমে। এক যুগ আগে মোবাইল ফোন থেকে মোবাইল ফোনে টাকা পাঠানোর সুবিধা যেভাবে বিপ্লব ঘটিয়েছিল, ডিজিটাল ব্যাংক তার চেয়েও বেশি সুবিধা নিয়ে আসছে। এর মাধ্যমে টাকা জমা, ঋণ গ্রহণ, প্রবাসী আয় গ্রহণসহ সব ধরনের আর্থিক সেবা এখন হাতের মুঠোয় চলে আসবে। কোনো ধরনের শাখা স্থাপন ছাড়াই সম্পূর্ণ ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচালিত হওয়ায় সেবার খরচ অনেক কমে যাবে, যা সাধারণ মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকে আরও সহজ করবে।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখনো ব্যাংকিং সেবার বাইরে রয়ে গেছে। ডিজিটাল ব্যাংকের কোনো ভৌগোলিক সীমা না থাকায় এটি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের কাছেও ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে পারবে, যা দেশের আর্থিক ব্যবস্থাকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলবে।
জানা গেছে, আগামী বছরের মধ্যেই দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের কার্যক্রম শুরু হতে পারে। এর আগে ডিজিটাল ব্যাংক অনুমোদনের প্রক্রিয়া নিয়ে দেশে-বিদেশে বিতর্ক ওঠায় এবার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে চাইছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিজিটাল ব্যাংকের লাইসেন্সের জন্য আবেদন গ্রহণ করার কথা জানিয়েছিল। পরে আবেদনপত্র জমা দেওয়ার সময় ২ নভেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। আবেদনকারীদের ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৩১ ধারা অনুযায়ী নীতিগত লাইসেন্স দেওয়া হবে। এ জন্য উদ্যোক্তাদের সিলগালা করা আবেদনপত্রের সঙ্গে ৫ লাখ টাকা প্রসেসিং ফি ও সব নথি জমা দিতে হবে। নথি সরাসরি ও ই-মেইলের মাধ্যমে জমা দেওয়া যাবে।
আবেদন বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বৈশ্বিক প্রযুক্তিনির্ভর পরিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দেশে দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতেই এ উদ্যোগ। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর আর্থিক সেবায় প্রবেশাধিকার বাড়বে, ক্ষুদ্র ও ছোট উদ্যোক্তারা সহজে ঋণ পাবেন এবং কর্মসংস্থান ও খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার হবে।
ডিজিটাল ব্যাংক এমন একটি ব্যাংক, যার নিজস্ব কোনো শাখা, উপশাখা, এটিএম বা সিডিএম (নগদ জমা মেশিন) থাকবে না। এর সব সেবা মিলবে শুধু ডিজিটাল মাধ্যমে, যেমন ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপ। এটি ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকবে। গ্রাহকদের সুবিধার জন্য ভার্চ্যুয়াল কার্ড ও কিউআর কোডের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক পণ্য ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। লেনদেনের জন্য গ্রাহকেরা অন্য ব্যাংকের এটিএম বা এজেন্ট সেবা ব্যবহার করতে পারবেন। এটি এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে হিসাব খোলা থেকে শুরু করে যেকোনো সেবা নেওয়ার জন্য কোথাও যেতে হবে না, যেকোনো স্থান থেকে ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করেই সেবা নেওয়া যাবে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে, এটি বড় বা মাঝারি শিল্পে ঋণ দিতে পারবে না। তবে ছোট আকারের ঋণ দিতে পারবে। এ ছাড়া কোনো ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমতি থাকবে না। বর্তমানে দেশে বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) চালু থাকলেও, সেগুলো ডিজিটাল ব্যাংকের একটি অংশমাত্র। ডিজিটাল ব্যাংক হবে একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যাংক, যা আর্থিক সেবাগুলোকে আরও সর্বজনীন করে তুলবে।
এ ছাড়া ডিজিটাল ব্যাংক ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা, নারী এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ঋণ ও সঞ্চয় সেবা দিয়ে আর্থিক ব্যবস্থায় তাঁদের অংশগ্রহণ বাড়াতে পারবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও লেনদেনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ঋণ বিতরণ করলে খেলাপি ঋণের ঝুঁকিও কমবে। যেমন বিকাশ অ্যাপ ব্যবহার করে প্রায় ১০ লাখেরও বেশি গ্রাহক সিটি ব্যাংক থেকে ৫৫ লাখ বারের বেশি ডিজিটাল ঋণ নিয়েছেন, যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। এই ধরনের ডিজিটাল ঋণকে আরও সহজ ও সর্বজনীন করা সম্ভব।
এ ছাড়া অঞ্চল, শ্রেণি-পেশাভিত্তিক সেবা চালু করে সহজেই যেকোনো গ্রাহকের কাছে পৌঁছে যেতে পারে ডিজিটাল ব্যাংক। পুরো সেবা ডিজিটাল মাধ্যমে হওয়ায় সহজেই যে কারও কাছে পৌঁছে যেতে পারবে এই ব্যাংক।
Comments