মানবিক বিপর্যয়ের মুখে রোহিঙ্গারা

শেষ হয়ে আসছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সহায়তার তহবিল। ফলে আশ্রয়শিবিরগুলোতে দেখা দিয়েছে তীব্র জ্বালানি সংকট, ব্যাহত হচ্ছে শিশুদের শিক্ষা ও সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, দ্রুত নতুন তহবিল জোগাড় না হলে খাদ্য ও জ্বালানির সংকট আরও প্রকট হবে, তৈরি হতে পারে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, এমনকি মানবিক বিপর্যয়ও।
জীবিকার তাগিদে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে চলে যাচ্ছে অনেক রোহিঙ্গা, কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছে সংঘাতে। নিরাপত্তা ঝুঁকির পাশাপাশি এই সংকট রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকেও ব্যাহত করছে। তবে চলতি বছরের জাতিসংঘে অনুষ্ঠিতব্য রোহিঙ্গা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে 'প্রত্যাবাসন' এবং 'তহবিল ঘাটতি' নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল আরও সক্রিয় ভূমিকা নেবে বলে আশাবাদী শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরে রোহিঙ্গা সহায়তার জন্য প্রয়োজন ৯৩৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। অথচ এর বিপরীতে এসেছে মাত্র ৬০ শতাংশ অর্থায়ন। ফলে সৃষ্টি হয়েছে খাদ্য, জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে ভয়াবহ সংকট।
বিশ্বে চলমান গাজা ও ইউক্রেন সংকটে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি সরে গেছে রোহিঙ্গা ইস্যু থেকে। ফলে দাতা দেশগুলোর আগ্রহ কমেছে। আর এ অবস্থাতেই বাংলাদেশে আশ্রিত প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৩ লাখ। নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ৫ হাজার ৫২০ জন। এর মধ্যে ২ লাখ ৪ হাজার ২৭৪টি পরিবার রয়েছে। আশ্রিতদের ৫২ শতাংশ শিশু, ৪৪ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক এবং ৪ শতাংশ বয়স্ক। নারী ৫১ শতাংশ, পুরুষ ৪৯ শতাংশ। প্রতি বছর গড়ে ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্মগ্রহণ করে, যা সংকটকে আরও জটিল করে তুলছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী আরও জানা যায়, ১৯৭৭ থেকে ৭৮ সালে ২ লাখ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ১ লাখ ৯০ হাজার মিয়ানমারে ফিরে যায়। ১৯৯১ সালে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮৭৭ জন অনুপ্রবেশ করে, যার মধ্যে ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন মিয়ানমারে ফিরে যায়। ২০১২ থেকে ১৬ সাল পর্যন্ত ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে। এরপর ২০১৭ সালে ৮ লাখ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করে।
আর জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর'র এক প্রতিবেদনে জানানো হয়, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘাত পুনরায় শুরু হওয়ার ফলে ২০২৩ সালের শেষ থেকে ২০২৫ সালের এ পর্যন্ত নতুন করে দেড় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় নিয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান সময় নিউজকে বলেন, 'রোহিঙ্গা সংকটে যুক্তরাষ্ট্র এখনো সবচেয়ে বড় দাতা দেশ হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের সহায়তায় ভাটা পড়েছে। ফলে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওগুলো ২০২৫ সালের জন্য পরিকল্পিত সহায়তা পরিকল্পনা পুনর্গঠন করেছে। তবে এই অর্থের এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে।'
তিনি আরও বলেন, 'সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, পূর্বে দাতা দেশগুলো পরবর্তী বছরের জন্য আগাম প্রতিশ্রুতি দিত, কিন্তু এবার ২০২৬ সালের জন্য এখনো তেমন কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। এর ফলে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়েছে খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও জ্বালানি খাত। বিশেষ করে, নভেম্বরের পর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) খাদ্য সহায়তা চালু রাখতে পারবে কিনা, তা অনিশ্চিত। বর্তমানে যে ১২ ডলার প্রদান করা হচ্ছে, সেটিও হয়তো কমে যেতে পারে। এরই মধ্যে জ্বালানি সংকট সংকট শুরু হয়েছে। শিক্ষা খাতে ১ হাজার ১৭৯ জন স্থানীয় শিক্ষক চাকরি হারিয়েছেন এবং বাকিরাও বেতন পাচ্ছেন না। আর স্বাস্থ্য খাতে অনেক এনজিও কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে, ফলে ৭০ জন স্বাস্থ্যকর্মী চাকরি হারিয়েছেন।'
কমিশনার বলেন, যদি মানুষ খাবার না পায়, শিশুরা পুষ্টিহীনতায় ভোগে, মায়েরা দুধের ঘাটতিতে পড়েন- তাহলে এটা একটি ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করবে।
তহবিল ঘাটতির কারণে ক্যাম্পের রোহিঙ্গাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। জীবিকার তাগিদে অনেকে ক্যাম্প ছেড়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করছে, যা নিরাপত্তার জন্য হুমকি।
বর্ধিত ৪ নম্বর ক্যাম্পের বাসিন্দা মিনু আরা বেগম (৩০) বলেন, 'সন্তান এখন যেভাবে খাচ্ছে সেটা যদি সামনের দিনগুলোতে খেতে না পারে তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়বে। নানা ধরনের অশান্তি সৃষ্টি হবে। আমরা তো মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে আসা মানুষ, এখানে ক্যাম্পেও যদি আমাদের খাদ্য কমিয়ে দিয়ে নির্যাতন করে তাহলে কীভাবে বাঁচব।'
মধুরছড়া ৪ নম্বর ক্যাম্পের এ-৩ ব্লকের বাসিন্দা সোনা মিয়া (৫৮) বলেন, 'মিয়ানমারে অসহায় হয়ে বাংলাদেশে এসেছি। এখানে যা দিচ্ছে তা দিয়ে কোনো রকম খেয়ে না খেয়ে দিন পার করছি। এখন এত বছর পর এসে যদি রেশন বরাদ্দ কমাচ্ছে, তখন আমরা কী খেয়ে বেঁচে থাকব?'
রহিম উল্লাহ (৩৫) বলেন, 'এখন যে সহায়তা দেয় তাও আমাদের হয় না। বরাদ্দের ১২ ডলার দিয়ে কোনো রকম চলে যাচ্ছে। সামনে যদি বরাদ্দ কমিয়ে দেয় তাহলে ক্যাম্পে সংকট বাড়বে।'
রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতা মোহাম্মদ জোবায়ের (৫০) বলেন, 'যখন রোহিঙ্গারা খেতে পাবে না তখন পুরো বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে এবং নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বে। চুরি, ডাকাতি করবে, ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাবে। তখন বিশ্ববাসী রোহিঙ্গারা খারাপ এটা বলবে।'
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত হয় অংশীজন সংলাপ। আর আসন্ন জাতিসংঘ সম্মেলনে রোহিঙ্গা ইস্যুকে গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান।
তিনি বলেন, 'জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের লক্ষ্য দুটি। প্রথমত, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়নে মিয়ানমার সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ানো। বিশ্ব সম্প্রদায় যাতে এই সংকট ভুলে না যায়, সে জন্য বিষয়টি বারবার তাদের সামনে উপস্থাপন করা। দ্বিতীয়ত, প্রত্যাবাসন কার্যক্রম সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের জন্য একটি মর্যাদাপূর্ণ জীবন নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা নিশ্চিত করা। এজন্য ইউএন সংস্থা, আন্তর্জাতিক এনজিও এবং বিভিন্ন দাতা দেশ, প্রতিষ্ঠান ও একক দাতাদের সহযোগিতা আকর্ষণ করা।'
তিনি আরও বলেন, 'মঙ্গলবার (৩০ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ সরকার যেসব লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে, আমি তারই প্রতিফলন তুলে ধরেছি। সরকার বিভিন্ন দাতা, বিশেষ করে অপ্রচলিত দাতা যেমন মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ও অন্যান্য ধনী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।'
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়শিবির এখন সংকটে নিমজ্জিত। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন, ইউএন সংস্থা ও অন্যান্য অংশীদারদের মতে, দ্রুত সহায়তা না পেলে কেবল বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
খাদ্য ঘাটতি, শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সেবার ভেঙে পড়া কাঠামো, এবং নিরাপত্তা ঝুঁকি- সবকিছু মিলিয়ে রোহিঙ্গা সংকট এখন আর কেবল মানবিক ইস্যু নয়, এটি একটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জে রূপ নিচ্ছে।
Comments