জেলে পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও কার্ড থাকতে হবে: ফরিদা আখতার

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার বলেছেন, জেলে পরিবারে পুরুষের পাশাপাশি নারীরও কার্ড থাকতে হবে। তিনি বলেন, 'সরকারের দেয়া জেলে কার্ড মাত্র ৪ শতাংশ নারী জেলের নামে বরাদ্দ থাকে। অথচ যারা মাছ ধরে তাদের পুরো পরিবার এ কাজে যুক্ত। এ প্রক্রিয়ায় অধিকাংশ সময় নারীদের বেশি কাজ করতে হয়। তাই পুরুষ জেলেদের সঙ্গে নারীদেরও কার্ড দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।'
সম্প্রতি রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বেসরকারি গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা সেন্টার ফর ন্যাচারাল রিসোর্স স্টাডিজ (সিএনআরএস) এবং জাগো নারী'র যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত 'টেকসই মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় নীতি সংলাপ'-এ প্রধান অতিথির বক্তব্যে উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
উপদেষ্টা আরও বলেন, 'সরকার লিঙ্গ সমতার বিষয়ে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।' তিনি স্বীকার করেন, এই খাতে নারীরা সম্পদে প্রবেশাধিকার ও স্বীকৃতির ক্ষেত্রে এখনো পিছিয়ে আছেন। তিনি নারী জেলেদের সমস্যার সমাধানে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেন।
এই সংলাপ মৎস্যজীবী নারীদের ক্ষমতায়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহ-অর্থায়নে এবং অক্সফাম বাংলাদেশের কারিগরি সহায়তায় 'এমপাওয়ারিং উইমেন থ্রু সিভিল সোসাইটি অ্যাক্টরস (ইডব্লিউসিএসএ)' প্রকল্পের অধীনে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়।
সংলাপে দেশের মৎস্য খাতে নারীদের অনস্বীকার্য অবদানকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার জোরালো দাবি উঠেছে। টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক মৎস্যনীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে আয়োজিত ওই সংলাপে সরকারি কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা এ বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন।
সংলাপে দুটি গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়- সিএনআরএস-এর 'নারী মৎস্যজীবীদের ক্ষমতায়ন: লিঙ্গসমতা ও টেকসই মৎস্যের পথনির্দেশ' এবং জাগো নারী'র 'ঝুঁকি ও করণীয়: বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে নারী মৎস্যজীবীদের ওপর একটি গবেষণা'। উভয় প্রতিবেদনে নারী মৎস্যজীবীদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দাবি জানানো হয় এবং লিঙ্গসমতাভিত্তিক মৎস্যনীতি প্রণয়নের রূপরেখা তুলে ধরা হয়।
সিএনআরএস-এর উপদেষ্টা ড. আমিনুল ইসলাম তার উপস্থাপনায় মৎস্যজীবীদের একটি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সংজ্ঞা প্রস্তাব করেন। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী, 'বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিক, লিঙ্গ নির্বিশেষে, মৎস্যজীবী হিসেবে পরিচিত হবেন যদি তার আয়ের ৫০%-এর বেশি জলজ খাদ্যসম্পদ (মাছ, চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি) থেকে আসে, অথবা তিনি যদি কর্মঘণ্টার অধিকাংশ সময় এই খাতে ব্যয় করেন। এর মধ্যে মাছ ধরা, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংগ্রহ, ও বিপণন- সবকিছু অন্তর্ভুক্ত হবে।' এই সংজ্ঞার মাধ্যমে পূর্ণকালীন ও মৌসুমি উভয় ধরনের মৎস্যজীবীকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
এছাড়াও ফিশারফোক আইডেন্টিটি কার্ড (এফআইডি) প্রদানের ক্ষেত্রে তিন ধরনের পরিচয়পত্রের প্রস্তাব করা হয়: ১. প্রতিষ্ঠিত শিল্পসংশ্লিষ্টদের জন্য: যারা জীবিকা নির্বাহের সহায়তার প্রয়োজন নেই। ২. নিয়মিত নৌকা-ভিত্তিক জেলেদের জন্য: যাদের জলবায়ু ও দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়তা এবং গভীর সমুদ্রে সুরক্ষার প্রয়োজন এবং ৩. নারী মৎস্যজীবী ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীর জন্য: যারা নিষেধাজ্ঞা বা আবাসস্থল ধ্বংসের মতো পরিস্থিতিতে জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন, এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ চান।
মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. মো. আবদুর রউফ নারী মৎস্যজীবীদের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জরুরি প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি জানান, এ খাতে নারীদের বিপুল অবদান থাকা সত্ত্বেও তারা অবমূল্যায়িত এবং মজুরিতে প্রায় ৩০% বৈষম্য বিদ্যমান। ভূমিহীনতার কারণে নারীরা জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে যে সমস্যার সম্মুখীন হন, তা সমাধানের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, 'নারীদের জন্য এফআইডি কার্ড চালু হলে সরকারি সহায়তা ও ভর্তুকি পাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।' তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'জাতীয় মৎস্যনীতিতে নারী-সংবেদনশীল নীতি প্রতিফলিত হবে এবং নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় নারীদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।'
অক্সফাম বাংলাদেশের কোঅর্ডিনেটর শাহাজাদি বেগম মৎস্য ভ্যালু চেনের প্রতিটি ধাপে মহিলাদের অপরিহার্য ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দেন। তিনি বলেন, 'নারীরা আহরণ থেকে প্রক্রিয়াজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে অবদান রাখলেও নিজেদের কাজের পূর্ণ সুফল থেকে বঞ্চিত হন।' তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, 'অনেক নারী মাছ বাছাইয়ের কাজে যুক্ত থাকায় আঙুলের ছাপ ক্ষয়ে যায়, যার ফলে তারা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন না।' তিনি ভূমিহীন মৎস্যজীবী মহিলাদের আবেদন প্রক্রিয়া সহজ করা এবং 'মান্তা' সম্প্রদায়ের নারীদের নিয়ে বিশেষ জরিপ পরিচালনার প্রস্তাব করেন।
সংলাপে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মৎস্য খাতে সমন্বিত নীতির গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা হয়। অংশগ্রহণকারীরা মনে করেন, এই ধরনের পদক্ষেপ পরিবেশ ও নারীদের জীবিকা রক্ষায় অপরিহার্য। এই নীতি সংলাপটি সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সিভিল সোসাইটি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হয়।
Comments