ছয় মাসে এনসিপির ১০ কেন্দ্রীয় নেতাকে ‘শোকজ’

বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়ানোর ঘটনায় ১০ জন কেন্দ্রীয় নেতাকে গত ছয় মাসে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এই ১০ নেতার মধ্যে পাঁচজনই দলটির অন্যতম নীতিনির্ধারণী ফোরাম রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশ করার দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগে 'তদবির ও হস্তক্ষেপ' এবং এনসিটিবির বই ছাপার কাজে 'কমিশন–বাণিজ্যে' জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে গত ২১ এপ্রিল তানভীরকে দল থেকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। পাশাপাশি তাঁকে কেন স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হবে না, তা জানাতে বলা হয়। এরপর থেকে তিনি দলে আর সক্রিয় হননি।
সর্বশেষ জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের বার্ষিকীতে (৫ আগস্ট) কক্সবাজার সফরের ঘটনায় এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের পাঁচজন নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়। এই পাঁচ নেতার মধ্যে চারজনই দলের রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য। তাঁরা হলেন মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ও দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ। কক্সবাজারের ঘটনায় দলের যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহকেও শোকজ করা হয়। তাঁরা সবাই কারণ দর্শানো নোটিশের জবাব দিয়েছেন। এরপর এনসিপির পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আর কিছু জানানো হয়নি।
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁদের লিখিত জবাব ৭ আগস্ট বিকেলে ফেসবুকেও তুলে ধরেছেন। লিখিত জবাবে কারণ দর্শানোর নোটিশকে বাস্তবভিত্তিক বলে মনে করেন না নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এ ছাড়া তিনি লিখিত জবাবে সাগরপাড়ে বসে গণ-অভ্যুত্থান, গণপরিষদ ও নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধানের রূপরেখাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে কক্সবাজারে যাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন।
অন্যদিকে লিখিত জবাবে 'বিধিবহির্ভূত' শোকজ দেওয়া এবং অতি উৎসাহী হয়ে তা গণমাধ্যমে প্রকাশ করা কতটুকু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচায়ক হয়েছে—সে প্রশ্ন তুলেছেন হাসনাত। এ ছাড়া তিনি লিখেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠের অনুষ্ঠানে (৫ আগস্ট জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে) ঐক্যের পরিবর্তে বিভাজন, শহীদ ও আহতদের পরিবর্তে মুষ্টিমেয় গোষ্ঠীর কথা বা মতামত প্রাধান্য পাওয়ায় সেখানে উপস্থিত থাকার প্রয়োজন বোধ করেননি তিনি। যে কারণে তিনি ৫ আগস্ট ঢাকার বাইরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পরবর্তী করণীয় নিয়ে চিন্তা করার অবকাশ পান।
গত মে মাসে সমন্বয়ক পরিচয়ে 'মব' (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) সৃষ্টির ঘটনায় পুলিশ তিন ব্যক্তিকে আটক করলে ধানমন্ডি থানা থেকে তাঁদের ছাড়িয়ে আনেন এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ। এ ঘটনায় সমালোচনার মুখে হান্নানকে (তিনিও এনসিপির রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্য) কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তিনি লিখিত জবাব দেওয়ার পর গত ২৯ মে এনসিপি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, হান্নান ভুল স্বীকার করেছেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের ভুলের পুনরাবৃত্তি হবে না বলে দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। হান্নানের ওপর আরোপিত কারণ দর্শানো নোটিশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে এনসিপি।
এনসিপির রাজনৈতিক পর্ষদের সদস্যরাও নানা বিতর্কে জড়াচ্ছেন, কারণ দর্শানোর নোটিশও দিতে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনায় ১০ জন নেতাকে 'শোকজ' করা হয়েছে বলে জানান এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব (দপ্তর) সালেহউদ্দিন সিফাত।
এছাড়া নৈতিক স্খলনের অভিযোগে গত ১৭ জুন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছিল এনসিপি। অভিযোগের বিষয়ে লিখিত ব্যাখ্যা চাওয়ার পাশাপাশি বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়ার আগপর্যন্ত তাঁকে এনসিপির সব সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। তুষার লিখিত ব্যাখ্যা দিলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দল থেকে চূড়ান্তভাবে কিছু জানানো হয়নি।
'আমাদের চেয়ে বড় মাফিয়া নেই'—গত ৯ জুন চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় এনসিপি আয়োজিত ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে এমন বক্তব্য দেন দলের কার্যনির্বাহী সদস্য ও বেসরকারি কারা পরিদর্শক জোবাইরুল আলম। এমন বক্তব্যের জন্য তাঁকেও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। তাঁর ক্ষেত্রে কী সিদ্ধান্ত হলো, সেটিও আনুষ্ঠানিকভাবে জানায়নি এনসিপি।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব জয়নাল আবেদীনের (শিশির) বিরুদ্ধে দৈনিক জনকণ্ঠ কার্যালয়ে বিশৃঙ্খলায় জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল গত মে মাসে। তখন তাঁর কাছে ব্যাখ্যা চেয়ে দল থেকে চিঠি দেওয়া হয়। তাঁকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়েছিল। তবে তাঁর জবাব এনসিপি কীভাবে নিয়েছে, সে বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আর কিছু জানানো হয়নি।
দলের এক নেতাকে মারধরের ঘটনায় এনসিপির রাজশাহী জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী নাহিদুল ইসলামকে গত ২৭ জুন সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁকে কেন স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে না, সে বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। এ ছাড়া মাদারীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব মাসুম বিল্লাহকে কুপিয়ে জখমের ঘটনায় গত ২৫ জুন এনসিপির মাদারীপুর জেলা ও সদর উপজেলা সমন্বয় কমিটি স্থগিত করা হয়। পাশাপাশি মাদারীপুর জেলা কমিটির দুই নেতাকে সব পদ থেকে বহিষ্কারও করেছে এনসিপি।
Comments