অন্তবর্তী সরকারের এক বছর: জনমনে স্বস্তি দেয়নি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি

বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ৪১ জন পুলিশ কর্মকর্তাসহ অন্তত ৬৩৭ জন লোক গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন, যা দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সবচেয়ে মারাত্মক দৃষ্টান্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় কানাডিয়ান সংস্থার একটি প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে। রিপোর্ট বলছে, ২০২৪ সালের আগস্টের অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে মব সহিংসতা সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কানাডা ভিত্তিক গ্লোবাল সেন্টার ফর ডেমোক্রেটিক গভর্ন্যান্স গত ২ আগস্ট এই প্রতিবেদনে বলেছে, "শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে ২০২৩ সালে মোট ৫১ জন মব সহিংসতায় মৃত্যুর ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছিল। ২০২৩ সালের তুলনায় মব লিঞ্চিংয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ১২ গুণ বেড়েছে"।
এই হিসেব নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। চ্যালেঞ্জ করতে পারে সরকার। তবে জনারিসরে ধারণা যে তা সত্য তার প্রমাণ পাওয়া যায় বর্তমান সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের কথায়ও। গত বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরতে গিয়ে এই আইন উপদেষ্টা বলেছেন, 'আমাদের সরকারের আমলে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, একটা হচ্ছে মিথ্যা মামলা, মানে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলা; আরেকটা হচ্ছে মব জাস্টিস। মব সন্ত্রাস আমি বলি। এই দুইটা আমাদের খুবই পীড়িত করে।'
এই লেখার সময় ভারাক্রান্ত মনে জানাতে হচ্ছে যে,৭ আগস্ট সন্ধ্যায় গাজীপুর মহানগরের চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় মসজিদ মার্কেটে প্রকাশ্যে মো. আসাদুজ্জামান তুহিন নামে এক সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত আসাদুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার। তিনি দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সব সময় সোচ্চার ছিলেন। এর আগে বুধবার গাজীপুরে পুলিশের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে এক সাংবাদিক বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে একদল দুর্বৃত্ত। দুর্বৃত্তরা ওই যুবককে পিটিয়ে এবং ইট দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেতলে দিয়েছে। যার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সমালোচনার ঝড় উঠে। আহত ওই যুবকের নাম মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বাংলাদেশের আলো নামে একটি দৈনিক পত্রিকার গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন।
প্রতিদিন এমন সব বিভৎস ঘটনা ঘটছে। মানুষ এক প্রকার স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিয়েছে এমন নিমর্মতাকে। গত এক বছর ধরে দেশটাই কেবলই এক মামলা আর হামলার দেশ হয়ে গেছে। মব সন্ত্রাস চালিয়ে যারা সমাজে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব সরকারের। সেটি সরকার কতটা আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে করছে বা আদৌ করছে কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে মানুষের মাঝে।
গত বছর ৮ আগস্ট শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস থেকে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ফিরে তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে বলেছিলেন, "আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করাই হবে তাঁর প্রথম কাজ"। কিন্তু এক বছর ধরে সেই প্রচেষ্টা দৃশ্যমান ছিল না।
গত এক বছর ধরে অধ্যাপক ইউনুসের সরকার বিভিন্ন মৌলিক সংস্কার নিয়ে সর্বাধিক রাজনৈতিক আলোচনা করেছে। কিন্তু এ সময়ে সংঘটিত নানা ধরনের অপরাধ ও এর বিস্তৃতির কারণগুলো সেভাবে আমলে নেওয়া হয়নি। এ সময়ে বিশেষ কিছু অপরাধের মাত্রা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা ও মব–সন্ত্রাসের মতো অপরাধ সরাসরি ভুক্তভোগী ছাড়াও আতঙ্কে ফেলেছে সাধারণ জনগণকে যার প্রভাব পড়েছে সামাজিক পরিসরে, ব্যবসা -বাণিজ্যে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের মাসিক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাসে ৭৩৬টি কন্যাশিশুসহ মোট ১ হাজার ৫৫৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৪৫টি শিশুসহ ৪৮১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬২ শিশুসহ দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১০৬ জন নারী এবং ১০ শিশুসহ ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৭ নারীকে। গত ছয় মাসে ৬১ শিশুসহ হত্যার শিকার হয়েছেন ৩২০ জন নারী। শুধু তা–ই নয়, চলতি বছরের ছয় মাসে বাংলাদেশে যে সংখ্যক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে; এই সংখ্যা ২০২৪ সালের পুরো বছরের চেয়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া গত ছয় মাসে দেড় শতাধিক ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে। বলা বাহুল্য, প্রকৃত ভুক্তভোগীর সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি হবে।
জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা ছাড়াও গত এক বছরে মব–সন্ত্রাস ঘটেছে শত শত। ডাকাতি, চুরি, খুন, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, কটূক্তি, প্রতারণা ও অপহরণ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দু:খজনক হলো, সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে এই মব–সন্ত্রাসকে পরোক্ষভাবে ন্যায্যতা দেওয়ার প্রবণতাও দেখা গেছে। এই মব–সন্ত্রাস নাগরিকের সামাজিক ও আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে একটি দেশের বিচারব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতি চরম অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেই প্রকাশ করছে।
সবচেয়ে বেশি আশংকার জায়গা হলো বাংলাদেশের একটি গোষ্ঠীর মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মে গেছে যে তারা যে অপরাধই করুক না কেন, তারা ঠিকই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে।
অধ্যাপক ইউনুস শুরুতে যেমন বলেছিলেন যে, আইনশৃঙ্খলা ঠিক করাই প্রধান কাজ, সেটি যদি তাঁর সরকার করতে পারত তবেই মানুষ আস্থার পরিবেশ পেত। সেই লক্ষ্যে সরকারের অন্যতম পদক্ষেপ হতে পারত, অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে অপরাধপ্রবণতার এই অনিবার্য ঊর্ধ্বগতির লাগাম টেনে ধরার কার্যকর পরিকল্পনা নিশ্চিত করা। সেটি করতে সরকার ব্যর্থ হয়েছে।
এ কথা সত্য যে, একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে কয়েক মাসের মধ্যে তা আমূলে পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। তবে যা সম্ভব ছিল তা হলো, এসব অপরাধ দমনে সদিচ্ছা, দৃশ্যমান প্রচেষ্টা ও উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া যা জনমনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারত।
গত ৫ আগস্ট সরকার জাতীয় নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। ভাবনার জায়গা হলো এই নির্বাচনের সময়টিতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বড় সংশয় রয়েছে মানুষের মনে।
Comments