চাঁদাবাজি অর্থনৈতিক পরিসরে ভ্রাম্যমাণ ডাকাতি

রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের চাঁদাবাজি, রাজনীতির নাম ভাঙ্গিয়ে চাঁদাবাজি আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। মানুষের মনে প্রত্যাশা ছিল, ফ্যাসিবাদের বিদায়ের পর যে নবজাগরণ তৈরি হয়েছে তাতে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণে এই 'ভ্রাম্যমাণ ডাকাত'-দের হাত থেকে দেশের রাজনীতি ও দেশবাসী মুক্ত হবে। কিন্তু তা যে হয়নি সেটা স্পষ্ট। বরং বলা চলে এই চাঁদাবাজি আরও নতুন রূপ পেয়েছে, পল্লবিত হয়েছে এবং নানা কায়দায় বিকশিত হচ্ছে।
এটা মেনে নেয়াই ভাল যে, বাংলাদেশে চাঁদাবাজি ছিল, আছে এবং থাকবেও এবং এই শিল্পে সব দলেরই অংশগ্রহণ আছে। সম্প্রতি রাজশাহী মহানগরের চাঁদাবাজদের যে তালিকা তৈরি হয়েছে, তাতে রাজশাহী মহানগর বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াতের পরিচয়ধারী ১২৩ জন 'চাঁদাবাজের' নাম রয়েছে। এই তালিকায় বিএনপি, ছাত্রদল ও তাদের সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী,ক্যাডার,সমর্থক থেকে শুরু করে ৪৪ জনের নাম ও পরিচয় আছে। একইভাবে পতিত আওয়ামী লীগের ২৫ জন এবং জামায়াতের ৬ জনের নাম আছে। সম্প্রতি একটি ছাত্রসংগঠনের নেতারা গুলশানের একজন সাবেক সংসদ সদস্যের বাড়িতে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছেন।
জুলাই অভ্যুত্থানের আগে এসব ঘটনায় পতিত সরকারি দলের নেতা–কর্মীদের জড়িত থাকার বিষয়টি প্রমাণিত। গণঅভ্যুত্থানের পর সেই দলটির নেতা কর্মীরা হয় আত্মগোপনে,নয় কারাগারে। তাহলে এসব চাঁদাবাজির ঘটনা কে বা কারা ঘটাচ্ছেন? এই প্রশ্নটাই এখন বড় -জিজ্ঞাসা।
চাঁদাবাজি থেকে দখলবাজি, এলাকায় এলাকায় মাস্তানির সিন্ডিকেট,সব ঐতিহ্যই রাজনীতির অবদান। কোন বিশেষ জামানায় হয়তো বেশি হয়েছে, কখনও সামান্য কম। প্রশ্ন হলো এই চাঁদাবাজি জিনিসটা কী? যেখানে কোনও রকম অধিকার ছাড়াই কেউ আর্থিক সুবিধা দাবি করে এবং বলপূর্বক আদায় করে মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় থাকার সুবাদে - সেটাই চাঁদাবাজি। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা বাজার থেকে সরাসরি টাকা দাবি করা সনাতনী চাঁদাবাজি। আছে জোর খাটিয়ে ঠিকাদারি বাগিয়ে নেয়া, বিভিন্ন ব্যবসা থেকে কমিশন আদায়, প্রভাব খাটিয়ে অর্থনৈতিক বিনিময় করা, মামলা থেকে খালাস করিয়ে দেয়ার নামে টাকা দাবি করা কিংবা টাকা না দিলে মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেয়া - কত নামের, আর কত প্রকারের যে চাঁদাবাজি! এই চাঁদাবাজির কল্যাণে দেশের মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস উঠছে, কিন্তু কোন রাজনীতিই চাঁদাবাজিকে ছাড়ছে না।
চাঁদাবাজির অর্থনৈতিক দিকটা ভয়ংকর। বাজার, পণ্য পরিবহন, বিপনন, ব্যবসা পরিচালনাসহ সর্বত্র চাঁদা দেয়ায় পণ্য ও সেবার দাম বাড়ে যে কারণে বেশি দামে পণ্য বা সেবা কিনতে বাধ্য হন সাধারণ মানুষ। বিনিয়োগের ওপর চাঁদা যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, সেটা শুধু যারা বিনিয়োগ করেন তারা বোঝেন। বাজারে, বন্দরে মাল খালাস থেকে শুরু করে কারখানা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহ সব ব্যবসা-বানিজ্যে বিনা পুঁজির ব্যবসা করছে এই চাঁদাবাজ নামের ভ্রাম্যমাণ ডাকাতরা। সবাই অতিষ্ঠ, কিন্তু কারও কিছু বলার নেই।
চাঁদাবাজি ব্যবসাকে অনিশ্চিত করে তোলে। ব্যবসায় ঝুঁকি আর অনিশ্চয়তা দুটোই থাকে। ব্যবসার পক্ষে ঝুঁকি হলো চ্যালেঞ্জ, চাঁদা হলো ক্ষতিকর,কারণ প্রথমটা মাপা যায়,আর দ্বিতীয়টা যায় না। সব ব্যবসা পরিকল্পনা অনিশ্চিত করে ফেলে এই চাঁদাবাজি। ঝুঁকি নিতে বিনিয়োগকারীদের আপত্তি নেই,কারণ কোন ঝুঁকিতে প্রত্যাশিত ক্ষতির পরিমাণ কত,সেটা হিসেব কষে নেওয়া যায়। সেই অঙ্কটা ব্যবসার খরচের খাতায় ঢুকে পড়ে এবং ব্যয়-লাভের হিসেবে প্রতিফলিত হয়। সমস্যা অনিশ্চয়তা নিয়ে। বেপোরোয়া চাঁদাবাজি যে অনিশ্চিত পরিস্থিতির সৃষ্টি করে তার কারণে ব্যয়ের পরিমাণ কত হবে,সেটা বোঝার উপায় নেই,ফলে সেই ব্যয় মিটিয়েও লাভ হবে কি না,সেটাও অনুমানের বাইরে চলে যায়। এই পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারী হয় ব্যবসা ছেড়ে দেন,আর নতুন উদ্যোক্তা ব্যবসাকে ভয় পান।
অনেক ক্ষেত্রে দলীয় চাঁদাবাজদের ওপর দলের নিয়ন্ত্রণ থাকে। ব্যবসায়ীরা সেই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রক-কে জানেন, বোঝেন। কিন্তু এখন বিরাট এক চাঁদাবাজ গ্রুপের ওপর কারও নিয়ন্ত্রণ নেই। এরা সরাসরি চাঁদাবাজি তো করেই, থানায় থানায় ঘুরে তালিকা ধরিয়ে পুলিশকে দিয়েও হয়রানি করায়। এই নিয়ন্ত্রণহীনতা যে বিপুল অনিশ্চয়তা তৈরি করে,তা ব্যবসার অনুকূল নয় কোনভাবেই।
চাঁদাবাজির চাইতে লাভজনক ব্যবসা আর নেই। ঘটছেও তাই। যেখানে টাকার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে,ভিড় বাড়ছে সেখানেই তৈরি হচ্ছে নতুন গোষ্ঠী-উপগোষ্ঠী। তাদের দাবিদাওয়া না মিটিয়ে ব্যবসা করার কোনও উপায় এ দেশে নেই।
দেশ বিনিয়োগ চায়। কিন্তু বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ নেই। অবস্থা দেখে দুটো রাস্তা ভাবনায় এসেছে। প্রথম,চাঁদাবাজি সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া। কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়,কারণ কর্মী-সমর্থকদের চাঁদাবাজির 'অধিকার' কেড়ে নিয়ে রাজনীতি করার মতো মেরুদণ্ডের জোর এ দেশের কোন রাজনৈতিক দলের নেই। দ্বিতীয় রাস্তা হল,চাঁদাবাজিকে সংগঠিত করা। অর্থাৎ,একটা মডেল দাঁড় করানো। কোন ব্যবসায় কত চাঁদা এবং কোন দলের জন্য কত - এরকম একটা স্বচ্ছ সিস্টেম তৈরি করে ফেলা। মুশকিল হল,সংগঠিত সিস্টেমও একসময় দল আর শাসকদের আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। কারণ রাজনৈতিক দলের স্থানীয় নেতাকর্মীরা অনেক বেশি 'স্বায়ত্তশাসিত'।
Comments