দেশের বিমা খাতের হাল হকিকত

এক নতুন ও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ বিমা সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। দেশের সুষম ও টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য বিমা খাতের বিকাশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ খাতের অর্থনীতিতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। গত দুই দশকের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে মানুষের গড় আয় ও প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়লেও বিমা খাতের প্রত্যাশিত অগ্রগতি হয়নি।
বরং পরিবর্তীত বাংলাদেশের বিমা খাত অনেক পিছিয়ে আছে। মানবসম্পদের দক্ষতা, সেবা পণ্যের সমারোহ, প্রযুক্তির ব্যবহার, সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতায় অনেক পিছিয়ে আছে এই খাত। অথচ মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কল্যাণে আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিমা খাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৯০ সালের পর থেকে বাংলাদেশে নিবন্ধিত বিমা প্রতিষ্ঠানের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি অনুমোদন পেয়েছে গত সরকারের আমলে। দেশে এখন মোট ৮২ টি বিমা কোম্পানি আছে যার মধ্যে লাইফ বিমা কোম্পানি ৩৬টি এবং নন-লাইফ বিমা কোম্পানি ৪৬টি। ১৭ বা ১৮ কোটি মানুষের দেশে বিমার আওতায় আছে দুই কোটিরও কম মানুষ। ২০২৩ সালে গ্রস প্রিমিয়াম আয় ছিল ১৮,২২৭ কোটি টাকা এবং একই বছরে বিমা কোম্পানিগুলোর মোট সম্পদ ছিল ৬৪,৬৪৬ কোটি টাকা।
বাজারের তুলনায় বেশি কোম্পানি
বিমা খাতের বিকাশে সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজারের তুলনায় অতিরিক্ত কোম্পানি। প্রতিবেশি ভারতে ৫৭টি, পাকিস্তানে ৪০টি ও শ্রীলঙ্কায় ২৮টির বিপরীতে বাংলাদেশে মোট বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮২। বলা হচ্ছে, দেশে প্রয়োজনের তুলনায় বেশিসংখ্যক ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থাকার কারণে এই খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। এর ফলে এই খাতে একধরনের অস্থিরতা লেগেই আছে। বেশি বেশি কোম্পানি খোলার অনুমোদনের সময় বলা হয়েছিল, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। কিন্তু বাস্তবে কিছু কর্মসংস্থান হলেও পুরো খাতটিই স্বাস্থ্যহীন রয়ে গেছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান করলেও অনেক সময় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে এই খাতের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়েনি; বরং কমেছে।
অর্থনীতিতে বিমা খাত
বাংলাদেশের জিডিপিতে বিমা খাতের অবদান মাত্র ০.৫৫ শতাংশ, যেখানে ভারতে ৪ দশমিক ২ শতাংশ এবং পাকিস্তানে শূন্য দশমিক ৯১ শতাংশ। উন্নত বিশ্বে এ হার ১৮ থেকে ২০ শতাংশ। আইডিআরের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ১ কোটি ৭১ লাখ ১০ হাজার মানুষ বিমা করেছেন। বিপুলসংখ্যক বিমা প্রতিষ্ঠান থাকা সত্ত্বেও দেশের গড় বিমা দাবি নিষ্পত্তির অনুপাত বৈশ্বিক মান ৯৭-৯৮ শতাংশ থেকে অনেক পিছিয়ে।
লাইফ ইন্স্যুরেন্স খাতে আস্থার সংকট
দেশের সম্ভাবনাময় খাতগুলোর মধ্যে বিমাশিল্প অন্যতম। তবে আস্থা ও ভাবমূর্তি সংকটে এ সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো জরুরি হয়ে পড়েছে। দেশে জীবনবিমা পলিসি নেওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানুষের আস্থাহীনতা। এর বাইরে দাবি নিষ্পত্তিতে কোম্পানিগুলোর প্রক্রিয়াগত জটিলতা, গ্রাহকদের দীর্ঘমেয়াদে আর্থিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে অনীহা ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাব এবং বিমা কোম্পানির এজেন্ট বা প্রতিনিধিদের কাছ থেকে সন্তোষজনক সেবা না পাওয়াও বিমা খাতের বিকাশে বাধা হয়ে আছে। এ কারণে দেশের মানুষের মধ্যে জীবনবিমা গ্রহণের হার বাড়ছে না।
নন-লাইফ খাতের প্রয়োজন সংস্কার
অসুস্থ প্রতিযোগিতা বা অনৈতিক চার্চাকে নন-লাইফ বিমার বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা হচ্ছে। দেশে বিমা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশি হওয়ায় অনৈতিক চর্চা উৎসাহিত হচ্ছে। নানা সময় যেসব সংস্কার প্রস্তাব এসেছে তা হলো: এজেন্সি সিস্টেম বাদ দিয়ে শূন্য শতাংশ কমিশন বাস্তবায়ন, দুর্বল কোম্পানিগুলোকে একীভূতকরণ, ব্যাংক ব্যবস্থার সাথে সমন্বয়, পণ্যের ব্যপ্তি ও বৈচিত্র আনয়ন। আস্থাহীনতা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারলে, উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ ও পুনর্বীমা দাবি নিষ্পত্তি সহজীকরণ করলে অনেকখানি আস্থা ফিরর আসবে।
ব্যাংকুরেন্স
ব্যাংকুরেন্স হলো বিমা কোম্পানির মধ্যে একটি অংশীদারিত্ব, যেখানে ব্যাংক তাদের গ্রাহকদের কাছে বিমা পণ্য বিক্রি করে। ব্যাংকের জন্য এই প্রোডাক্ট নতুন আয়ের পথ তৈরি করছে। ব্যাংক তাদের গ্রাহক বেইসকে ব্যবহার করতে দিয়ে বিমা কোম্পানিগুলো নতুন গ্রাহক পেতে সহায়তা করেছে। ব্যাংকের বিদ্যমান বিতরণ নেটওয়ার্ক ব্যবহার করায় বিমা বিক্রি করতে পারায় বিমা কোম্পানিগুলোর বিতরণ খরচ কমে আসছে। ব্যাংকুরেন্স বিমা কোম্পানির বাজারকে প্রসারিত করতে সাহায্য করছে এবং এর মাধ্যমে বিমা কোম্পানির ব্র্যান্ড সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ছে।
সরকার যা করতে চলেছে
বিমা আইন ২০১০-এ বড় ধরনের সংশোধনী আনতে যাচ্ছে সরকার। আইনটি সংশোধনের লক্ষ্য-বিমা কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে পরিবারতন্ত্র রোধ করে দুর্নীতি প্রতিরোধ, এবং বিমা গ্রাহক বা পলিসিধারীদের স্বার্থ রক্ষা। প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলোতে পরিচালনা পর্ষদে পরিচালক নিয়োগে কঠোর বিধান, পরিবারের মালিকানায় সীমা, এবং দেউলিয়া বা ব্যর্থ বিমা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়ার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতোমধ্যেই তাদের ওয়েবসাইটে অধ্যাদেশটির খসড়া প্রকাশ করেছে এবং জনমত আহ্বান করেছে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা শেষে চূড়ান্ত করা হবে এই অধ্যাদেশ।
আইনের সংশোধনীতে ইডরার নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা বড় পরিসরে সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। খসড়া অধ্যাদেশটি পাস হলে বিমা কোম্পানির অর্থায়নে গঠিত সাব-সিডিয়ারি কোম্পানি, ফাউন্ডেশন বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানও পরিদর্শন করতে পারবে কর্তৃপক্ষ। বাধ্যতামূলক নির্দেশনা জারির ক্ষমতা পাবে। পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থের পরিপন্থি মনে করলে কর্তৃপক্ষ ওই কোম্পানির নতুন প্রিমিয়াম গ্রহণ নিষিদ্ধ করতে পারবে এবং পলিসিহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় কর্তৃপক্ষ যেকোন আদেশ দিতে পারবে।
Comments