সত্যের শেষ প্রহরী
শহরের এক জীর্ণ গলির ভেতরে শতাব্দী প্রাচীন দালানটা যেন কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার ক্ষয়ে যাওয়া ইটের ফাঁকে ফাঁকে জন্মেছে আগাছা, শ্যাওলা-ধরা ছাদটা কোনো এক বর্ষায় ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়। সেই দালানের এক অন্ধকার ঘরে বাস করেন বৃদ্ধ সাংবাদিক হাশেম চৌধুরী। বয়স আশির কোঠায়, শরীরটা ন্যুব্জ হয়ে এলেও চোখের দৃষ্টি এখনো ইস্পাতের মতো ধারালো। প্রায় ষাট বছরের সাংবাদিক জীবনে তিনি দেখেছেন অনেক উত্থান-পতন—স্বাধীনতার উন্মাতাল ভোর, স্বৈরাচারের জমাট অন্ধকার আর গণতন্ত্রের জন্য রক্তাক্ত সংগ্রাম। তাঁর কলম গর্জে উঠেছে বহুবার, আবার শাসকের রোষানলে স্তব্ধও হয়েছে।
আজ তাঁর কোনো সংবাদপত্র নেই, নেই কোনো পাঠকও। তাঁর একমাত্র আশ্রয় এখন একটি পুরনো, লাল মলাটের খাতা। এটিই তাঁর দিনলিপি, তাঁর কালের দলিল। যখন বাইরের পৃথিবী টেলিভিশনের আলোচনা অনুষ্ঠান আর পুরস্কার বিতরণী সভার আলোয় ঝলমল করে, তখন এই স্যাঁতসেঁতে ঘরে তিনি লিখে চলেন সেই সময়ের না বলা ইতিহাস, মুখোশপরা তথাকথিত শিক্ষিতদের ভণ্ডামির ইতিবৃত্ত।
সেদিনও তিনি দিনলিপি খুলে লিখলেন—
'ইদানিং তাহারা 'সুশীল'। তাহাদের বাক্স্বাধীনতা আর মানবাধিকারের জন্য মায়াকান্না দেখে হাসি পায়। কিন্তু সেদিন কোথায় ছিল এই সুশীলতা, যেদিন আমার সহকর্মী রফিককে ভিন্নমতের জন্য সভাকক্ষ থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে জুতার মালা পরানো হয়েছিল? কোথায় ছিল তাদের বিবেক, যখন আমার শিক্ষক অধ্যাপক মিজানুরকে ছাত্রদের সামনে অপমান করে থুতু ছিটানো হয়েছিল? শ্রমিকের অধিকার নিয়ে কথা বলায় তোফাজ্জলকে ভাত খাওয়ানোর কথা বলে ডেকে নিয়ে যখন লাশ করে ফেরত দেওয়া হলো, তখন তো এই সুশীলদের কণ্ঠস্বর শোনা যায়নি। আজ নিজেদের গায়ে সামান্য পচা ডিমের ছিটে লাগতেই তাদের চিৎকারে আকাশ-বাতাস ভারী—'এ কেমন অসভ্যতা! রাজনীতিতে সুস্থ ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে!'
কলম থামিয়ে তিনি সিগারেট ধরালেন। টিমটিমে আলোর নিচে ধোঁয়ার কুণ্ডলি তার চিন্তার মতোই পাকিয়ে উঠতে লাগলো। জানালার বাইরে গলিতে কুকুরের অকারণ চিৎকার। হাশেম সাহেবের চোখে ভেসে ওঠে এক অন্য শহর। যে শহর একদিন স্বপ্নের রাজধানী ছিল, তা আজ যেন বিচারহীনতার এক উন্মুক্ত কসাইখানা। এখানে আদালতের সামনে থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে হেনস্তা করা হয়, হাটের মাঝে নারীর সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়, আর গলির বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে।
অথচ সমাজের বিবেক বলে পরিচিত মানুষগুলো তখন নীরবতার চাদরে মুখ ঢেকে রাখে। বিদেশি সম্মেলনে গিয়ে মানবতার বুলি আওড়ায় আর টেলিভিশনের পর্দায় নরম গলায় বলে—এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। আজ যখন সেই অপমানের ঢেউ তাদের নিজেদের কিনারে এসে লেগেছে, তখনই তারা সহনশীলতার উপদেশ দিচ্ছে।
দিনলিপির পাতায় তাঁর কলম আবার চলতে শুরু করে—
"মৃতদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে ফেলার মতো বর্বরতা দেখেও যারা একটি সম্পাদকীয় লেখার সাহস পায়নি, আজ কোনো এক বক্তার দিকে ছুড়ে দেওয়া কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যে তারাই কেঁদে আকুল। তাদের কাছে মানবতার সংজ্ঞা কি তবে স্থান-কাল-পাত্রভেদে বদলে যায়?"
এই নিঃসঙ্গ জীবনে একদিন এক ঝলক তাজা বাতাসের মতো এলো নাসরিন। সদ্য সাংবাদিকতায় আসা এক তরুণী, চোখে স্বপ্ন আর জিজ্ঞাসার আলো। হাতে একটি লেখার খাতা, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ।
নাসরিন মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলো, "চাচা, এই যে এত কষ্ট করে সব লিখে রাখছেন, কিন্তু এসব তো কেউ পড়ছে না। এর কী কোনো অর্থ আছে?"
হাশেম সাহেব ম্লান হাসলেন। বললেন, "মা, ইতিহাস লেখা আর খবর ছাপানো এক জিনিস নয়। খবর আজকের জন্য, আর ইতিহাস ভবিষ্যতের জন্য রেখে যাওয়া এক অমূল্য সাক্ষ্য। আজ হয়তো কেউ এর খোঁজ নেবে না, কিন্তু পঞ্চাশ বছর পর যখন সত্য অনুসন্ধানে কেউ আসবে, তখন এই পাতাগুলোই কথা বলবে।"
নাসরিনের মনে হলো, এই বৃদ্ধের জীর্ণ খাতাটি হয়তো একদিন সত্যিই মহাকালের দলিল হয়ে উঠবে।
কয়েকদিন পরই শহরের রাজপথে এক মিছিলে হাশেম সাহেবের তরুণ সহকর্মী আক্তারের ওপর হামলা হলো। তার মাথায় পচা ডিম ছুড়ে মারা হলো। সঙ্গে সঙ্গে যেন বিস্ফোরণ ঘটলো। 'সুশীল সমাজ' জেগে উঠলো। বিবৃতিতে ছেয়ে গেল খবরের কাগজের পাতা—"আমরা এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। এটি সুস্থ রাজনীতির পরিপন্থী।" টেলিভিশনের পর্দায় বুদ্ধিজীবীদের আলোচনার ঝড় বয়ে গেল।
খবরটা শুনে হাশেম সাহেব কেবল হাসলেন। পাশে বসা নাসরিনকে বললেন, "দেখেছ মা, ওরা কেমন বিবেকবান হয়ে উঠেছে! অথচ এই একই রাজপথে দেশের একজন শ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল। সেদিন তাদের মুখে কুলুপ আঁটা ছিল।"
নাসরিন বিড়বিড় করে বললো, "তাহলে কি বিবেকও বেছে বেছে আসে, চাচা?"
হাশেম সাহেব কোনো উত্তর দিলেন না। তাঁর চোখের কোণের বলিরেখাগুলো আরও গভীর হলো।
শহরের সাধারণ মানুষ এই পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবাদে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। যারা স্রোতের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে, তাদের কপালে "রাষ্ট্রদ্রোহী" বা "বিদেশি শক্তির দালাল" তকমা সেঁটে দেওয়া হয়। যারা একসময় ভিনদেশি আধিপত্যের বিরুদ্ধে গলা ফাটাতো, আজ তারাই সীমান্তের ওপারে উপঢৌকন পাঠায়। যারা একদিন মেধার ভিত্তিতে চাকরির জন্য আন্দোলন করেছিল, আজ তারাই আত্মীয়তার জোরে বিচারকের আসনে বসে।
হাশেম সাহেব তাঁর দিনলিপিতে লিখলেন—
"আজকের এই অবক্ষয়ের জন্য দায়ী কারা? যারা নদীর জলে লাশ ভাসতে দেখেও চুপ থেকেছে, যারা শিক্ষকের অপমানকে নীরবে সম্মতি দিয়েছে, আর নারীর অসম্মানকে 'রাজনৈতিক খেলা' বলে এড়িয়ে গেছে—তারাই দায়ী। আজ নিজেদের গায়ে আঁচড় লাগতেই তারা মানবতার গান গাইছে। ইতিহাস কি এই ভণ্ডামিকে ক্ষমা করবে?"
একদিন ফোন এলো। ওপাশ থেকে ভেসে এলো এক শীতল, ধাতব কণ্ঠ, "লেখালেখি বন্ধ করুন, নয়তো পরিণতি ভালো হবে না।"
নাসরিন খবরটা শুনে আঁতকে উঠে বললো, "চাচা, এবার থামুন। খুব বেশি ঝুঁকি হয়ে যাচ্ছে।"
হাশেম সাহেব শান্তভাবে হাসলেন। বললেন, "মা, কলম যদি থেমে যায়, তবে তো আমি বেঁচে থেকেও মৃত।"
সে রাতেই তিনি তাঁর শেষ লেখাটি লিখলেন। এরপর এক ভোরে নিঃশব্দে চলে গেলেন। শহরের ব্যস্ততম পত্রিকাগুলোর ভেতরের পাতায় এক কলামে ছাপা হলো—"প্রবীণ সাংবাদিক হাশেম চৌধুরীর জীবনাবসান।"
তাঁর মৃত্যুর পর নাসরিন সেই লাল মলাটের দিনলিপিটি হাতে তুলে নিলো। প্রতিটি পাতায় জমে আছে সময়ের না বলা যন্ত্রণা, ভণ্ডামির দলিল আর এক নির্ভীক বৃদ্ধের দীর্ঘশ্বাস। নাসরিনের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। সে বুঝতে পারলো, হাশেম চৌধুরী কোনো সাধারণ সাংবাদিক ছিলেন না; তিনি ছিলেন সত্যের শেষ প্রহরী। তাঁর জীবন কোনো ব্যর্থতা নয়, বরং একটি জীবন্ত দলিল—যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে। এই দিনলিপির কালি শুকিয়ে গেলেও এর ভেতরের আগুন কখনো নিভবে না। এইবার সেই আগুন ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব তার।
Comments