দাস্তানগড়িয়া : শেষ গল্পবাজের কাহিনি

শীতের সন্ধ্যা। কুয়াশার ভেতর অল্প আলোয় ভেসে ওঠে গ্রামবাংলার হাট। বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো কেরোসিনের বাতি কাঁপতে কাঁপতে জ্বলে আছে। দোকানদাররা হাঁকডাক করছে, পিঠার হাঁড়িতে ধোঁয়া উড়ছে, আর মাঝখানে খোলা জায়গায় ভিড় জমেছে একদল মানুষ। সেখানে বসেছেন এক বৃদ্ধ—গলায় গামছা, হাতে বাঁশি আর বুকে ঝোলানো পুরনো মৃদঙ্গ। সবাই তাঁকে চেনে—আবদুল করিম দাস্তানগড়িয়া।
করিমের মুখ খুললেই যেন অন্য জগৎ খুলে যায়। তিনি কণ্ঠে ভর দেন, হাতের তালে মৃদঙ্গ বাজে, চোখেমুখে অভিনয়ের ছাপ।
—শুনগো, শুনগো, সেই কাহিনি, যখন ভোলা নদীর তীরে বেহুলা ভেসেছিল শ্বশুরবাড়ির আশা নিয়ে…
শিশুরা চোখ বড় বড় করে বসে থাকে, তরুণরা কানে ঝুলে থাকে, বৃদ্ধরা দুঃখ ভোলে। গল্প কখনো ইতিহাস, কখনো পুরাণ, আবার কখনো গ্রামীণ লোককাহিনি। করিমের জিহ্বায় কাহিনি যেন ঝর্ণার জলের মতো ঝরে পড়ে।
গল্পের মানুষরা
দাস্তানগড়িয়ারা একসময় বাংলার প্রতিটি হাটে, মেলায়, জমিদার বাড়ির আসরে হাজির হতেন। তারা শুধু গল্প বলতেন না—গল্প গড়তেন। শব্দ, সুর, দেহভঙ্গি, এমনকি নিস্তব্ধতাকেও ব্যবহার করতেন। যেন একাই পুরো নাট্যমঞ্চ।
তাদের ভাণ্ডারে থাকত—
রাজা-বাদশাহর কাহিনি
মোগলযুদ্ধ ও বীরত্বগাথা
বেহুলা-লখিন্দরের প্রেম
লালন-ফকিরের দেহতত্ত্ব
লোকালয়ের ভয়ঙ্কর ভূতের গল্প
প্রতিটি কাহিনি ছিল মানুষের মনকে ছুঁয়ে যাওয়ার মতো। দুঃখী কৃষক শুনে সান্ত্বনা পেত, প্রেমিক-প্রেমিকা শুনে মুগ্ধ হতো, আবার কেউ কেউ জীবনের শিক্ষা নিত।
সামাজিক ভূমিকা
দাস্তানগড়িয়ার আসর শুধু বিনোদন নয়, ছিল সামাজিক শিক্ষার স্থানও। গ্রামের মানুষ জানত যুদ্ধের ইতিহাস, নৈতিকতার শিক্ষা, প্রেম ও দুঃখের দর্শন—সবকিছু গল্পের মাধ্যমে। আধুনিক বই বা খবরের কাগজের আগে তারাই ছিল মানুষের মুখপত্র।
তাদের কথায় ভেসে উঠত প্রতিবাদও। একেকজন দাস্তানগড়িয়া জমিদারদের অন্যায় বা সমাজের কুসংস্কার গল্পে মিশিয়ে ব্যঙ্গ করতেন। শ্রোতারা বুঝত, কিন্তু সরাসরি বিরোধ না করেই প্রতিবাদের স্বর ছড়িয়ে দিতেন তারা।
অবক্ষয়
কালের নিয়মে সবকিছু বদলে গেল। প্রথমে ছাপাখানা, তারপর থিয়েটার, সিনেমা, রেডিও, টেলিভিশন—সব মিলিয়ে দাস্তানগড়িয়ার আসর হারাতে লাগল ভিড়। শহর তো বটেই, গ্রামেও আর মানুষ রাতভর গল্প শুনে কাটাতে চাইল না।
করিমের মতো অনেক দাস্তানগড়িয়া জীবিকার পথ বদলাতে বাধ্য হলেন। কেউ হলেন দিনমজুর, কেউ মাঠের কাজ নিলেন, কেউ নিঃশব্দে হারিয়ে গেলেন। আজও হয়তো কোনো গ্রামীণ মেলায় কোনো বৃদ্ধ গুনগুনিয়ে গল্প শুরু করেন, কিন্তু শ্রোতা থাকে হাতে গোনা কয়েকজন।
শেষ আসর
আবদুল করিম দাস্তানগড়িয়া নাকি শেষ আসরে বলেছিলেন—
'আমার গল্প যদি কেউ মনে রাখে, তবে আমি মরব না। গল্প মরে না, মানুষ মরে'।
তারপর সত্যিই তিনি হারিয়ে গেলেন, কেউ জানল না কোথায় কবর হলো। কিন্তু যেদিন তিনি গল্প শোনাতেন, গ্রামের বাতাস অন্যরকম হয়ে যেত।
উপসংহার
দাস্তানগড়িয়ারা শুধু পেশাজীবী ছিলেন না, তারা ছিলেন বাংলার সমষ্টিগত স্মৃতির বাহক। তাদের জিহ্বায় ইতিহাস বেঁচে থাকত, তাদের কণ্ঠে সমাজ হাসত-গাইত-কাঁদত।
আজ যখন আমরা প্রযুক্তির যুগে দাঁড়িয়ে গল্প পড়ি স্ক্রিনে বা শুনি কৃত্রিম কণ্ঠে, তখন মনে হয়—একজন দাস্তানগড়িয়ার মুখে মুখে বলা গল্পের উষ্ণতা আর পাওয়া যায় না।
সময় এসেছে আমরা তাদের ইতিহাস লিখে রাখি, রেকর্ড করি, লোকোৎসবে ফিরিয়ে আনি। কারণ দাস্তানগড়িয়া হারিয়ে গেলে হারিয়ে যাবে বাংলার সেই জীবন্ত গল্পবাজ আত্মা।
Comments