নীরব নায়কের গল্প — ৮

রায়হানের ছেলে রুদ্র ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে। একদিকে স্কুলের খরচ, অন্যদিকে ফ্ল্যাটের কিস্তি আর মায়ের চিকিৎসা — সংসারের হিসেব যেন প্রতিদিন একটু একটু করে ভারী হয়ে উঠছে। লেখালেখির স্বপ্নকে একপাশে সরিয়ে বাস্তবতার তাগিদে রায়হান এখন এক প্রতিষ্ঠানের পাবলিক রিলেশনস বিভাগে চাকরি করে। চাকরির শুরুতেই ছয় মাসের জন্য বিদেশে প্রশিক্ষণে যেতে হয়েছে তাকে।
রায়হান না থাকায় এই শহরের বিকেলগুলো যেন আরও নিঃশব্দ হয়ে উঠেছে। জানালার কাচে ভেসে আসা বিকেলের রোদ নরম হয়ে ঘরের কোণায় ছড়িয়ে থাকে, নিঃশব্দে জানান দেয় তার অনুপস্থিতি।
স্কুল থেকে ফিরে রুদ্র বইয়ের ব্যাগটা টেবিলে ছুঁড়ে ফেলে বারান্দার দোলচেয়ারে বসে পড়ে। হাতে প্রিয় কমিকসের বই থাকলেও চোখে এক ক্লান্ত ছায়া, মুখে হালকা বিষণ্ণতা। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে অর্ণা ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝে যায় — কিছু একটা ঠিক নেই। ধীরে ধীরে তার পাশে বসে মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করে,
— কি হয়েছে রুদ্র? এত চুপচাপ কেন আজ?
রুদ্র একটু ইতস্তত করে নিচু গলায় বলে,
— আম্মু, আজ স্কুলে সবাই বলছিল বাবা দিবসে বাবাকে কী গিফট দেবে। সবাই কিছু না কিছু বলেছে, শুধু আমি চুপ করে ছিলাম। ওরা জিজ্ঞেস করলো — তুই কী দিবি?
অর্ণার বুকের গভীরে এক চাপা কষ্ট জেগে ওঠে।
বাবার দীর্ঘ অনুপস্থিতি যে ছোট্ট ছেলের মনে দাগ রেখে যাচ্ছে, তা অনুভব করে সে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রু নিঃশব্দে মুছে ফেলে।
নরম গলায় বলে,
— তুই তো জানিস, বাবা তোকে কত ভালোবাসে। তোর কথাই তো সে রোজ বলে, তোকে ছাড়া তার দিনই শুরু হয় না। এটাই তো সবচেয়ে বড় উপহার, তাই না?
রুদ্র হালকা হেসে মাথা নাড়ে,
— তাহলে আমিও একটা কার্ড বানাবো। ছবি এঁকে পাঠিয়ে দেবো। বাবা খুশি হবে, তাই না?
অর্ণা তাকে বুকে টেনে নেয়। শব্দহীন এই বোঝাপড়ায় মা-ছেলের মধ্যে গড়ে ওঠে এক উষ্ণ, অনন্য সম্পর্ক — যেখানে অনুভবই মুখ্য।
রমজানের এক মিষ্টি দুপুর। জানালার পর্দা দুলছে হালকা বাতাসে। রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে দুধ-সেমাইয়ের চেনা গন্ধ। বারান্দায় বসে থাকা অর্ণা শুনছে ফুটতে থাকা দুধের ফেনা, চামচের টুংটাং শব্দ, আর স্মৃতির গন্ধে ভেসে বেড়াচ্ছে ছোটবেলার দিনগুলোয়।
ঠিক তখন রান্নাঘরের দরজায় এসে টোকা দেয় রুদ্র আর তার বন্ধু অনাবিল।
দু'জন মিলে বলে,
— আম্মু, হাঁড়ি চাটবো!
— আন্টি আমাকেও দেন! — বলে অনাবিল হাত বাড়িয়ে।
অর্ণা হেসে ওঠে। সেই হাসিতে ফিরে আসে তার শৈশব। বাবার মধ্যবিত্ত সংসারে, পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে দুধ-সেমাইয়ের হাঁড়ির তলা কে পাবে — সেই লুকোচুরি এখনো তার মনে স্পষ্ট।
অর্ণা হাঁড়ির তলা থেকে তুলে দেয় সেমাই। রুদ্র আর অনাবিলের চোখে-মুখে আনন্দ ঝলকে ওঠে।
— আম্মু, আরেকটু দাও!
— আর নেই রুদ্র, কাল আবার করবো, — বলে অর্ণা স্নেহভরা কণ্ঠে।
রুদ্র তার একমাত্র সন্তান। ভাইবোনের কোলাহলময় শৈশব পায়নি সে। মাঝে মাঝে অর্ণার মনে হয়, নিঃসঙ্গ এই শৈশবটা কি ঠিকঠাক কাটছে? তবু ফ্ল্যাটের কমনস্পেসে রুদ্রদের এক ছোট্ট রঙিন জগৎ গড়ে উঠেছে — অনাবিল, নুহা, তাসফিয়া মিলে ছবি আঁকা, গল্প পড়া আর বিকেলের হাওয়ায় ছুটে বেড়ানো। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই একদিন রুদ্রের জীবনের সোনালি স্মৃতি হয়ে থাকবে।
অর্ণা জানে — সময় বদলায়, মানুষ বদলায়, কিন্তু শৈশবের গল্পগুলো বদলায় না। আর বদলায় না আত্মীয়স্বজনের সেই পুরনো প্রশ্নগুলোও, — একটা বাচ্চা কেন? আরও হলে তো ভালো হতো না?
কখনো কষ্ট লাগত, এখন অভ্যস্ত। মানুষ প্রশ্ন করতে ভালোবাসে — যেন অন্যের জীবনটা তাদের লেখা কোনো উপন্যাস, যেখানে ইচ্ছে মতো প্রশ্নচিহ্ন আঁকা যায়।
সংসার কেবল দায়-দায়িত্বের খাতা নয়। এখানে থাকে দুধ-সেমাইয়ের মিষ্টি গন্ধ, হাঁড়ি চাটার নিষ্পাপ আনন্দ আর পুরনো দিনের স্মৃতির বাক্স। এই ছোট ছোট মুহূর্তগুলোই গড়ে তোলে জীবনের আসল গল্প।
পাশের ঘর থেকে ভেসে আসে ডালের হাঁড়ির সুবাস। রুদ্র বই বন্ধ করে বারান্দায় এসে আকাশের দিকে তাকায়।
একদিন স্কুল ছুটির দিনে অর্ণা রুদ্রকে নিয়ে গিয়েছিল মিরপুর চিড়িয়াখানায়। রুদ্র সে কী খুশি! মুগ্ধ চোখে দেখে পশুপাখি, আর প্রশ্ন করে একের পর এক।
বাসায় ফিরে খাওয়ার পর অর্ণা যখন বিছানায় বিশ্রামে, তখন ছেলে তার পাশে এসে বলে,
— মা, দুটো কাক চিড়িয়াখানার বাইরে ছিল। তুমি কী দেখেছিলে?
অর্ণা হেসে ওঠে।
অদৃশ্য হলেও এই বন্ধন ঠিক কতটা দৃঢ় — তা শুধু সময়ই জানে।
যেদিন রায়হান প্রশিক্ষণ শেষে ফিরবে, সেদিন বিকেলটা হয়তো আবার রোদের ঝিকিমিকি আলোয় ভরে উঠবে।
Comments