টক্সিক পরিবেশে চাকরি করবেন নাকি নতুন করে ভাববেন, মনোবিদের পরামর্শ

আজকাল অনেক পেশাজীবীর মুখেই একটি শব্দ শোনা যায়—"টক্সিক অফিস এনভায়রনমেন্ট"। এটি এমন একটি কাজের পরিবেশ, যেখানে সহকর্মীদের আচরণ, ব্যবস্থাপনার ধরন বা কাজের চাপে কর্মীরা মানসিকভাবে চূড়ান্তভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। শুধু কর্মক্ষমতা নয়, একটি টক্সিক অফিসের প্রভাব পড়ে একজন ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, মানসিক স্বাস্থ্য এবং পারিবারিক সম্পর্কেও। তাহলে কি টক্সিক পরিবেশে চাকরি করা একেবারেই ক্ষতিকর? নাকি কোনো ইতিবাচক দিকও আছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছেন সাইকোলজিস্ট সূরাইয়া ইসলাম মুন্নি। তার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে টক্সিক পরিবেশের ক্ষতি, কিছু সাময়িক সুবিধা এবং কীভাবে এই পরিবেশে নিজেকে মানসিকভাবে সুরক্ষিত রাখা যায়।
টক্সিক অফিসেও কিছু সুবিধা থাকতে পারে: শুনতে অদ্ভুত মনে হলেও, টক্সিক পরিবেশে কাজ করার কিছু স্বল্পমেয়াদি সুবিধা রয়েছে জানান সাইকোলজিস্ট সূরাইয়া ইসলাম মুন্নি। তিনি যে বিষয়গুল উল্লেখ করেন তা হলো:
আর্থিক নিরাপত্তা: চাকরি ধরে রাখলে অন্তত বেকারত্বের ভয় থাকে না। মাস শেষে বেতন নিশ্চিত থাকে, যা অর্থনৈতিক দিক থেকে আপনাকে স্বস্তি দিতে পারে।
আত্ম-উপলব্ধির সুযোগ: এমন পরিবেশে আপনি বুঝতে পারেন—কোন বিষয়গুলো আপনার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, আর কোন পরিস্থিতিতে আপনি মানিয়ে নিতে সক্ষম। এর ফলে ব্যক্তিত্ব ও মূল্যবোধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়।
সহনশীলতা ও খাপ খাওয়ানোর শিক্ষা: টক্সিক পরিবেশে টিকে থাকতে গিয়ে আপনি শিখতে পারেন কীভাবে কঠিন মানুষ ও পরিস্থিতির সঙ্গে পেশাদারভাবে আচরণ করতে হয়।
টক্সিক অফিসের নেতিবাচক দিক: সাইকোলজিস্ট সূরাইয়া ইসলাম মুন্নি টক্সিক অফিসে কাজ করার নেতিবাচক দিকও বলেছেন। তার ভাষায় এ ধরনের পরিবেশে কাজ করা মানেই প্রতিনিয়ত মানসিক ও শারীরিক চাপে থাকা। ক্ষতিগুলো হয় বহুমাত্রিক:
১. মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি: দীর্ঘসময় টক্সিক পরিবেশে কাজ করলে দেখা দিতে পারে উদ্বেগ, হতাশা, বিষণ্নতা ও অতিরিক্ত মানসিক চাপ।
২. শারীরিক সমস্যা:ঘন ঘন মাথাব্যথা, ক্লান্তি, ঘুমের অসুবিধা, খাওয়ার অনিয়ম ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীর ও মন—দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
৩. আত্মবিশ্বাস কমে যাওয়া: অফিসের টক্সিক পরিবেশে অন্যদের নেতিবাচক মন্তব্য ও আচরণ, বিভিন্নভাবে বুলিংয়ের শিকার হলে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস কমে যেতে পারে। অফিসে সবার মাঝে থেকেও একাকিত্ব অনুভব হতে পারে।
৪. ব্যক্তিজীবনে প্রভাব: টক্সিক অফিসের পরিবেশ অনেক সময় সরাসরি ব্যক্তিজীবনের ক্ষতির কারণ হয়। অনেকেই আছেন যারা মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের সাথে বাজে আচরণ করে থাকে। এতে পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
৫. কাজের প্রতি অনীহা:সবসময় টক্সিক পরিবেশে থাকলে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়। অনেক সময় কাজ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়, মানসিক ক্লান্তি অনুভব হয়, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে।
যেভাবে টক্সিক পরিবেশে মানসিকভাবে টিকে থাকবেন:
> এসারটিভ হোন, আক্রমণাত্মক নয়: নিজের অনুভূতি স্পষ্টভাবে প্রকাশ করুন, কিন্তু কাউকে দোষারোপ না করে। পেশাদার আচরণ বজায় রাখুন।
> গসিপ এড়িয়ে চলুন: কাজের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্ব বজায় রাখুন। অন্যদের আড়ালে তাদের সম্পর্ক কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। তা না হলে আপনার কারণে হয়তোবা অন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
> ব্যক্তিগত সীমা নির্ধারণ: সম্পর্কের সীমানা নির্ধারণ করুন। নিজের মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিতে প্রয়োজনে "না" বলা শিখুন। অন্যদের সম্মান করুন এবং কেউ আপনাকে ছোট করলেও সে বিষয়ে মাথা খামাবেন না।
> বুলিদের এড়িয়ে চলুন: টক্সিক অফিসের পরিবেশ অনেক সময় সরাসরি ব্যক্তিজীবনের ক্ষতির কারন হয়। অনেকেই আছেন যারা মানসিক চাপ মোকাবিলা করতে না পেরে পরিবারের সদস্যদের সাথে বাজে আচরণ করে থাকে। এতে পরিবারের সবার সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়।
> চিন্তা পুনর্গঠন করুন: চিন্তাকে নতুন ভাবে সাজান। যেমন- "আমার যাওয়ার যায়গা নেই" এমনটি না ভেবে নিজেকে বার বার বলুন - "আমি এখনো শিখছি কিভাবে এই ধরনের পরিস্থিতি সামলে নিতে হয়। প্রয়োজনে আমি অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি খুজবো।" অফিস দ্বারা নিজের ব্যক্তিজীবন আঘাতপ্রাপ্ত হলে, নিজেকে বলুন- "অফিস আর বাসা দুটো ভিন্ন জায়গা। আমি বাসার অনুভুতি আর চিন্তা যেমন কাজের ক্ষেত্রে আনবো না, একিভাবে অফিসের দু:শ্চিন্তা বাসায় নিয়ে যাবোনা।"
> ইতিবাচক সম্পর্ক গড়ুন: মনে রাখবেন সবাই আপনার শত্রু নয়। যাদের সঙ্গে সৎ ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব, তাদের পাশে থাকুন। টক্সিক সহকর্মীদের কথা বিশ্বাস করা ক্ষেত্রে সচেতন হোন।
> ট্রিগার চিহ্নিত করুন: কোন ঘটনা বা কার কথায় আপনি সবচেয়ে কষ্ট পান—তা খেয়াল করুন। ভবিষ্যতের জন্য একটা ব্যাকআপ কৌশল তৈরি রাখুন।
> নিজের যত্ন নিন: নিজের দিকে মন দিন, নিজের যত্ন নিন। পুষ্টিকর খাবার, পর্যাপ্ত ঘুম, মেডিটেশন,পরিবার বা বন্ধুদের সময় দেয়া, গুণাবলি স্মরণ করা, ইলেকট্রনিক ডিভাইস থেকে দূরে থাকা ইত্যাদি।
> এক্সিট প্ল্যান রাখুন: পরিস্থিতি সহ্যের বাইরে গেলে নতুন চাকরির সন্ধান করুন। কিন্তু নতুন চাকরি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু বলবেন না।
যেকোনও অফিসে সমস্যা থাকেই, তবে টক্সিক পরিবেশ দীর্ঘমেয়াদে মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে বুঝেশুনে চাকরি ছাড়বেন নাকি নিজেকে তৈরি করে পরিস্থিতি মোকাবিলা করবেন। আর যেকোনও সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যাচাই করতে হবে সত্যি আপনি টক্সিক পরিবেশে কাজ করছেন নাকি। অন্যদিকে, নিজের আত্মমর্যাদা ও মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিন। প্রয়োজন হলে বিকল্প খুঁজুন, কিন্তু সিদ্ধান্ত নিন সচেতনভাবে ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। কারণ আপনি শুধু একজন কর্মী নন, একজন মানুষও।
Comments