আমাদের স্মার্টফোন যে ১০টি জিনিসকে অবসরে পাঠিয়েছে

বর্তমান সময়ের একটি স্মার্টফোন একাই যেন এক বহুমুখী প্রযুক্তি যন্ত্র। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এটি একে একে দখল করে নিয়েছে বহু একক যন্ত্রের জায়গা। একসময় আমাদের ব্যাগে বা ড্রয়ারে থাকা অনেক ডিভাইসই এখন স্মার্টফোনে ঠাঁই পেয়েছে।
অন্তত এমন ১০টি ডিভাইস যা আপনি প্রতিদিন ব্যবহার করতেন, কিন্তু এখন হয়তো আপনার সেসব জিনিসের কথা মনেও পড়ে না। কারণ স্মার্টফোন সেসব ডিভাইসের কাজ দখলে নিয়ে নিমিষেই করে ফেলছে।
ক্যামেরা
ডিজিটাল ফটোগ্রাফির প্রসঙ্গ এলেই অনেকেরই প্রথম পছন্দ ছিল কম্পেক্ট ক্যামেরা। কিন্তু স্মার্টফোন ছবি তোলার সব কাজ করছে খুব দক্ষতার সাথে। এবং সুবিধার দিক বিবেচনা করে ফটো তোলার ক্ষেত্রেও কম্পেক্ট ক্যামেরার জায়গা দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোন। যদিও প্রথম দিকের ফোনক্যামেরার কোয়ালিটি সন্তোষজনক ছিল না। কিন্তু পরে আলাদা করে মেমোরি, ব্যাটারিসহ নানান কিছু বহন না করে ভালো ছবি তোলার যে সুবিধা হালআমলের স্মার্টফোন দিয়েছে, সেটাই ক্যামেরা জায়গা দখলে নেয়ার মূল টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
এছাড়া, এআই প্রযুক্তিসহ নানাবিদ ফিচার থাকায় ছবি তোলার প্রসঙ্গ এলেই আমাদের পকেট থেকে বেরিয়ে আসে স্মার্টফোন। এবং বেশির ভাগ মানুষ বিশেষ করে তরুণরা শুধু ছবি তোলার জন্য আলাদা একটি ডিভাইস বহন করছেন না।
পকেট ক্যালকুলেটর
আপনাদের মনে থাকার কথা TI-35 মডেলের পকেট ক্যালকুলেটরের বিষয়ে। একটি সায়েন্টিফিক পকেট ক্যালকুলেটর। মনেহতো এটি দিয়ে কেবলমাত্র পারমাণবিক সমীকরণ ছাড়া সব হিসেব কষে ফেলা সম্ভব। ছোট্ট সবুজ এলইডি স্ক্রিনটিকে বিস্ময়কর মনেহতো। স্কুল থেকে অফিস, প্রায় সব ক্ষেত্রে হিসেব মানেই ক্যালকুলেটরের উপস্থিতি। কম্পিউটার একটি গণনাকারিযন্ত্র হলেও ক্যালকুলেটর খুবই কম্পেক্ট হওয়ায় এটি হিসেবে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হতো।
কিন্তু আজকাল, সেই একই কার্যকারিতা আপনার স্মার্টফোনের ক্যালকুলেটর অ্যাপেই আছে। এবং এ অ্যাপ সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক, গ্রাফিক্যাল এবং এমনকি প্রতীকী গণিতও সমাধান করতে পারে। ফলে আপনার হাতের স্মার্টফোনটি প্রায় তার নিজ আকৃতির আরেকটি ডিভাইসকেও অবসরে পাঠিয়েছে।
যদিও ক্লাসরুম বা পরীক্ষার হলে এখনও ক্যালকুলেটর টিকে আছে, বরং বলা ভালো- টিকিয়ে রাখা হয়েছে। কারণ ক্লাসে বা পরীক্ষার কেন্দ্রে মোবাইল ব্যবহারের অনুমতি নেই। ফলে পরীক্ষার্থী ছাড়া আর কাউকে আর ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে দেখা যায় না।
জিপিএস ডিভাইস
গারমিন এবং টমটমের মতো ডেডিকেটেড জিপিএস ডিভাইসগুলো সে সময়ে ছিল বেশ যুগান্তকারী। ভ্রমণকারীদের বুক পকেটে ভাঁজ করে রাখা কাগজের মানচিত্রের সেরা বিকল্প হয়ে উঠেছিল জিপিএস ডিভাইস।
কিন্তু আপনার হাতে থাকা স্মার্টফোন নেভিগেশনের এক নতুন সংজ্ঞা নিয়ে হাজির হয়েছে। গুগল ম্যাপের মতো অ্যাপগুলো কেবল একের পর এক দিকনির্দেশনা দিয়েই শেষ করে না বরং লাইভ ট্রাফিক আপডেট, স্মার্ট রিরুটিং সুবিধা দিচ্ছে। আপনার ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সিঙ্ক করে আপনার ভ্রমণ পরিকল্পনাকে আরও সহজ করে তোলে। এ অ্যাপগুলোর সার্চটুল আপনার স্থানীয় গাইড হিসেবেও কাজ করছে- যা আপনাকে ভ্রমণের সময় পেট্রোল পাম্প, রেস্তোরাঁ এবং দর্শনীয় স্থান খুঁজে পেতে সহায়তা করে। আপনার স্মার্টফোন গারমিন এবং টমটমের মতো ডেডিকেটেড জিপিএস ডিভাইসগুলোকেও অবসরে পাঠিয়েছে।
যদিও নৌসহ বিশেষ কিছু যানবাহন চালক এবং অ্যাডভেঞ্চারার; হাইপার-স্পেসিফিক নির্দেশনা প্রয়োজন তাদের কাছে এখনও উচ্চমানের জিপিএস ডিভাইসের কদর আছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষের কাছে জয় হয়েছে স্মার্টফোনের।
এমপিথ্রি প্লেয়ার
৯০ দশক ও এর আশপাশের প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা জানে, প্রথমবারের মতো একটি এমপিথ্রি প্লেয়ারের মালিক হওয়ার অনুভূতিটা তীব্র ছিল। ছোটো আকৃতির একটি স্ক্রিন আর কয়েক ডজন গান- এ নিয়ে হাইস্কুল মনখারাপের দিনগুলো কেটে যেত। ছোট্ট এ ডিভাইসের মাঝেই নিজের সঙ্গে বোঝাপড়ার অন্য এক জগত তৈরি হয়ে যেত।
যাইহোক, স্মার্টফোন সঙ্গে নিয়ে এলো স্পটিফাই, অ্যাপল মিউজিক এবং ইউটিউব মিউজিকের মতো মিউজিক স্ট্রিমিং অ্যাপ। আরও উন্নত সংস্করণের সাউন্ড কোয়ালিটি দিতে শুরু করে এসব অ্যাপ। এবং ধীরে ধীরে এমপিথ্রি প্লেয়ারের মালিক হওয়ার বিশেষ ব্যাপারটি মুছে যেতে থাকে। এমনকি শুধু গান শোনার জন্য এটি বহন করা অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠে। এবং স্মার্টফোনের বহুমুখিতায় এমপিথ্রি প্লেয়ারও চলে গেছে অনন্ত অবসরে।
অ্যালার্ম ঘড়ি
খুব ভোরে উঠে ইবাদতে, অফিসে বা স্কুলে যেতে হবে, এমন পরিস্থিতির সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী ছিল অ্যালার্ম ঘড়ি। প্রতিদিন এক ধরনের শব্দে তড়িঘড়ি করে জেগে উঠা সময়গুলোকে পাল্টে দিয়েছে একটি স্মার্টফোন।
আমাদের শোবার ঘরে, বিছানার পাশে জায়গা করে নিয়েছে স্মার্টফোন। আর ধীরে ধীরে পাশে সরে যেতে থাকলো অ্যালার্ম ঘড়ি। আপনার ফোন অ্যালার্ম ঘড়ি, স্লিপ ট্র্যাকার, হোয়াইট নয়েজ মেশিন হিসেবে কাজ করে, সবকিছুই পাওয়া যাচ্ছে একটি ডিভাইসে। অ্যালার্ম ঘরিতে যা পারতেন না স্মার্টফোনে তার অনেক বেশি অপশন আপনার হাতের নাগালে থাকছে- একাধিক অ্যালার্ম সেট, স্নুজ কাস্টমাইজ, শত শত অ্যালার্ম টোন থেকে একটি টোন নির্বাচনসহ আরও অনেক ফিচার পাচ্ছেন স্মার্টফোনে।
তবুও, সবাই এটা পছন্দ করে না। ঘুম গবেষক এবং স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিরা ফোন শোবার ঘর থেকে সরিয়ে রাখার পরামর্শ দেন। কারণ একটি সাধারণ অ্যালার্ম ঘড়ি আপনাকে মধ্যরাতে সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রোল করতে বা চোখ খোলার আগেও কাজের ইমেল চেক করতে প্ররোচিত করে না। কিন্তু সতর্কতা সত্ত্বেও আমরা বেছে নিয়েছি মোবাইলকে, আর অবসরে পাঠিয়েছি অ্যালার্ম ঘড়িকে।
টর্চলাইট
ধীরে ধীরে ঐতিহ্যবাহী টর্চলাইটের জায়গা দখল করে নিয়েছে স্মার্টফোনের এলইডি ফ্ল্যাশ। অন্ধকার রাতে পথচলা, হঠাৎ কিছু খুঁজতে বা লোডশেডিংয়ের সময় দ্রুত আলোর ব্যবস্থা করতে এখন মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট ব্যবহার হচ্ছে। এর জন্য আলাদা কোনো ডিভাইস বহন করতে হচ্ছে না।
তবে, এখনও কিছু বাস্তবতা আমাদের মোকাবেলা করতে হয়, যেখানে টর্চলাইট জরুরি হয়ে পড়ে। তবে সেটা প্রতিদিনের বিষয় নয়। বনে বা পাহাড়ে ভ্রমণকালে দীর্ঘসময় চার্জ থাকবে এমন উজ্জ্বল আলোর দরকার পড়ে, তখন টর্চ কাজে আসে। এবং এসব জায়গায় অসাবধানতাবশত যদি স্মার্টফোন হাত থেকে পড়ে যায়, তাহলে কয়েক হাজার টাকার ক্ষতি হতে পারে, কিন্তু টর্চ পড়ে গেলে বড়জোর কয়েকশ টাকায় সেটা কাটিয়ে উঠা সম্ভব।
ভয়েস রেকর্ডার
একটা সময় ছিল যখন ছাত্র, সাংবাদিক, অথবা গান কিংবা বক্তব্য রেকর্ড করার জন্য ডিজিটাল ভয়েস রেকর্ডার থাকা আবশ্যক ছিল। ব্যবহার করাও খুব সহজ ছিল: শুধু রেকর্ড টিপলেই, আপনার মনের কথা রেকর্ড করে ফেলা যেত।
তবে আজকাল আমার কোনো কিছু রেকর্ড করতে স্মার্টফোনের ভয়েস রেকর্ডারে গিয়ে কাজ শুরু করে দিতে পারি। সাউন্ড কোয়ালিটি নিয়েও ভাবতে হয় না, এলোমেলো কথা নিয়েও ভাবতে হয় না। এআই আমাদের রেকর্ডকে ইম্প্রুভ করে দেয়। এবং সহজে এলোমেলো কথা কেটে ফেলা যাচ্ছে। এবং সহজে সে রেকর্ড পছন্দ অনুযায়ী জায়গায় ব্যবহার করতে পারি। রেকর্ড থেকে টেক্সটে রূপান্তর করা যায়। যেকারোর সাথে সহজে শেয়ারও করা যায়। ভয়েস রেকর্ডার অবসরে গিয়ে আমাদের কাছে রেখে গেছে স্মার্টফোনকে।
স্ক্যানার
জরুরি কাগজপত্র ডিজিটাল উপায়ে সংরক্ষণ করার বিষয় এলেই যেতে হতো ছোটোখাটো কম্পিউটার আকৃতির স্ক্যানার যন্ত্রের কাছে। যেটা ধীর গতির ও সহজে বহনযোগ্য ছিল না। ফলে স্ক্যানের প্রসঙ্গ এলেই শরীরে অলসতা কাজ করতো।
এখন, আপনার স্মার্টফোন ডকুমেন্ট স্ক্যান করতে পারে এবং সেগুলোকে আরও উজ্জ্বল করতে পারে। অ্যাডোব স্ক্যান, মাইক্রোসফট লেন্স, ক্যামস্ক্যানার, এমনকি বিল্ট-ইন নোটস অ্যাপের মতো স্ক্যানার অ্যাপগুলো সেকেন্ডের মধ্যে ছবি স্ক্যান, অটো-ক্রপ এবং হাই রেজুলেশনের PDF এ রূপান্তর করতে পারে।
ফলে দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য একটি ফোন স্ক্যানার ডিভাইসটির জায়গা দখল করেছে।
পার্সোনাল ডিজিটাল অ্যাসিস্ট্যান্ট
স্টাইলাস এবং গ্রেস্কেল স্ক্রিনসহ পাম পাইলট গেমটির কথা মনে আছে? এ ডিভাইস কল করতে বা ছবি তুলতে পারত না, কিন্তু এটি ক্যালেন্ডার পরিচালনা করতে, নোট লিখতে এবং পরিচিতি সংরক্ষণ করতে পারতো।
এখন এসব স্মার্টফোনে আরও উন্নতভাবে পাওয়া যায়—'হেই সিরি' বা 'হেই গুগল' বললেই সব হুকুম পালন করে।
ই-রিডার ডিভাইস
এ ডিভাইসটি নিয়ে এখনই এটা বলা যাচ্ছে না যে এটি অবসরে চলে গেছে। আরও বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ Kindle-এর মতো ডেডিকেটেড ই-রিডারগুলো এখনও অদৃশ্য হয়ে যায়নি। আসলে, তারা তাদের নিজস্বতা ধরে রেখেছে। তবে, অনেক সাধারণ পাঠকের কাছে স্মার্টফোন মৌলিক ই-রিডার হয়ে উঠছে। আপনার ফোনে বই, ম্যাগাজিন এবং নিবন্ধ পড়ার ক্ষমতা, বিশেষ করে সেরা ই-বুক রিডার অ্যাপ এবং বিভিন্ন সংবাদ অ্যাপের মাধ্যমে পড়াকে আরও সহজলভ্য করেছে।
এরপরেও, ই-রিডারের মধ্যে নিঃসন্দেহে বিশেষ কিছু আছে। ই-ইঙ্ক স্ক্রিনগুলো আসল কাগজের মতো দেখায়, যা চোখের জন্য দীর্ঘ সময় ধরে পড়া অনেক সহজ করে তোলে। একবার চার্জ করলে এগুলো কয়েক সপ্তাহ ধরে চলে, সরাসরি সূর্যের আলোতে দুর্দান্ত কাজ করে। যখন কেউ সত্যিই কোনো বইয়ের গভীরে ডুবে যেতে চায়, তখন ই-রিডার ভালো উপায়।
স্মার্টফোন কেবল ভিন্ন ভিন্ন ডিভাইসের পরিবর্তে প্রযুক্তির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ককে নতুন রূপ দিয়েছে। আগে ভিন্ন ভিন্ন গ্যাজেট ভর্তি ব্যাগের প্রয়োজন হত, এখন এটি একটি অল-ইন-ওয়ান ডিভাইসে চলে এসেছে। এবং সেটা আপনার পকেটে ফিট হয়ে যায়। এটি অনেক দিক থেকে দুর্দান্ত, যদিও এটি অতীতের জন্য কিছুটা আকুলতাও জাগিয়ে তোলে।
Comments