‘সবাই মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণ করতে হবে’
টাঙ্গুয়ার হাওর আমাদের জাতীয় সম্পদ। হাওরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সরকার বদ্ধপরিকর। হাওরের সম্পদ রক্ষায় স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো উদ্যোগই সফল হবে না। হাওরের পরিবেশ ও জীবিকা একে অপরের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। হাওরের সম্পদ এমনভাবে ব্যবহার হোক যাতে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম উভয়ই এর সুবিধা পায়।
পরিবেশ অধিদপ্তরের আয়োজনে টাঙ্গুয়ার হাওরের সমাজ-ভিত্তিক ব্যবস্থাপনার অধীনে জলাভূমি সম্পদের সংরক্ষণ এবং বিচক্ষণ ব্যবহারের উপর আয়োজিত পরামর্শ কর্মশালায় বক্তারা এসব কথা বলেন। বুধবার (১৯ নভেম্বর) দুপুরে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া।
কর্মশালায় হাওর ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা, অবৈধ শিকার ও সম্পদ আহরণ রোধ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করার কৌশলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
কর্মশালার শুরুতে প্রকল্পের ভিডিও প্রেজেন্টেশন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক (ঢাকা গবেষণাগার) ও প্রকল্প পরিচালক শাহেদ বেগম। টাঙ্গুয়ার হাওর প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের আওতায় জলাভূমি সম্পদের সংরক্ষণ এবং বিচক্ষণ বা টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণ বিষয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা) ও উপ-প্রকল্প পরিচালক জাওয়াতা আফনানের সঞ্চালনায় অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার, পরিচালক (প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা) এ কে এম রফিকুল ইসলাম, পরিচালক (পরিকল্পনা) হাসান হাছিবুর রহমান, ইউএনডিপি'র প্রোগ্রাম এনালিস্ট একেএম আজাদ রহমান প্রমুখ।
এসময় বক্তব্য রাখেন, সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি এ কে এম আবু নাছার, ইরার প্রজেক্ট কো-অর্ডিনেটর কৃষিবিদ শেখ কামরুল হোসেন, ৭১ টিভির প্রতিনিধি শহীদনূর আহমেদ, বাসসের প্রতিনিধি আমিনুল হক, এনটিভির প্রতিনিধি দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী, যমুনা টিভির প্রতিনিধি সোহানের রহমান, টাঙ্গুয়ার হাওর কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি বজলুর রহমান, টাঙ্গুয়ার হাওর ইক্যো টুরিস্ট গাইড অখিল তালুকদার প্রমুখ।
কর্মশালায় পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক শাহেদ বেগম বলেন, এ প্রকল্পে হাওরের জলাভূমি সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ স্থান নির্ধারণ, মানচিত্র প্রস্তুত করে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা হবে। হাওরের ইকোসিস্টেমের মূল্য নির্ধারণ ও জীববৈচিত্র্যের রেজিস্টার তৈরি করা হবে। হাওর ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের মাধ্যমে টেকসই অর্থায়নকৌশল প্রণয়ন, অনুমোদন ও বাস্তবায়ন করা হবে। তিনি আরও জানান, এ প্রকল্পে স্থানীয় মানুষদের সম্পৃক্ত করতে ৩৮০টি পরিবারকে বিকল্প আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া হবে। স্থানীয় মানুষজনকে নিয়ে জলাভূমি বাগান, বিলের আবাসস্থল উদ্ধার, মাছ ও অন্যান্য জলজ জীববৈচিত্র্যের জন্য ২২৬৩ হেক্টর এরিয়ায় ১০টি অভয়াশ্রম তৈরি করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে প্রকল্পে।'
সুনামগঞ্জ পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি এ কে এম আবু নাছার বলেন, 'গত ২৫ বছরে টাঙ্গুয়ার হাওরের ধ্বংস ছাড়া কিছুই হয়নি। আগে হাওরের যে পরিবেশ ছিলো তা এখন আর নাই৷ দিনদিন পরিবেশ প্রতিবেশের অবনতি হচ্ছে। গত ২৫ বছরে ১০০ কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। এখন যে ৪৪ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সেই প্রকল্পে কাজের কাজ কতটুকু হবে তা এখন দেখার বিষয়৷
তিনি আরও বলেন, 'এর আগেও বিভিন্ন প্রকল্পের শুরুতে আমাদেরকে বিভিন্ন কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে পরবর্তীতে কিছুই দৃশ্যমান হয়না। প্রকল্পের নামে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে। হাওরের মানুষের কোনো লাভ হয়নি। প্রকৃতি ও পরিবেশের উন্নয়ন হয়নি। সবাই মিলেই টাঙ্গুয়ার হাওরকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে এসেছেন।'
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার বলেন, 'টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণ করলে হাওর থেকে প্রতিবছর ২২শ কোটি টাকার সম্পদ পাওয়া যাবে। আমরা সবাই মিলে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণ করতে চাই। সেক্ষেত্রে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
তিনি আরও বলেন, টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে কোনো ধরনের ক্ষতিকর কাজ করা যাবে না৷ প্লাস্টিকের ছাঁই ব্যবহার, কারেন্ট জাল ব্যবহারসহ হাওরের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। ধ্বংসাত্মক কোনো কাজ কেউ যদি করে তাহলে আপনাদেরকে সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এলাকার মানুষকে বুঝাতে হবে যে, এগুলো করা যাবে না৷ এগুলো করলে হাওরের ক্ষতি হবে। তারপরও যদি মানুষজন ক্ষতি করতে চায় তাহলে আইননুসারে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেজন্য সবাই মিলেই টাঙ্গুয়ার হাওরকে সংরক্ষণ করতে হবে।'
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, 'হাওরের ওপর স্থানীয় মানুষজনের নির্ভরতা বেড়ে গেছে। বিকল্প কর্মসংস্থান না পেয়ে মানুষজন বিভিন্ন জাল ব্যবহার করে হাওরে মাছ ধরছে। প্লাস্টিকের ছাঁই ব্যবহার করছে। গাছ কাটছে, পাখি ধরছে। এগুলো মূলত কর্মসংস্থান না থাকার কারণেই মানুষজন করছে।'
তিনি আরও বলেন, 'টাঙ্গুয়ার হাওরের যে জায়গায় সারাবছর পানি থাকার কথা সেই জায়গায় মানুষজন এখন হাঁটাচলা করেন। যে জায়গা গুলো কোর জোন হিসেবে পরিচিত সেখানে মাত্র আড়াই থেকে তিন ফুট পানি থাকে। পানির পরিমাণ কম থাকায় সহজেই মানুষজন মাছ ধরছে। বৈদ্যুতিক শক দিয়ে সহজেই মাছ ধরে নিয়ে যাচ্ছে জেলেরা। এই কারণে হাওরকে খনন করা জরুরি। পানির পরিমাণ যদি হাওরে বেশি থাকে তখন কিন্তু শক দিয়ে মাছ ধরা কঠিন হয়ে পড়বে।'
জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া আরও বলেন, 'টাঙ্গুয়ার হাওরকে রক্ষা করতে হলে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। এই অঞ্চলের মানুষজনকে আরও সচেতন হতে হবে। একইসাথে বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দেখবেন টাঙ্গুয়ার হাপর ধীরেধীরে তার পূর্বের রূপ ফিরে পাবে।'
সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে জেলার তাহিরপুর ও মধ্যনগর উপজেলায় এই হাওরের অবস্থান। এটি বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট (আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি)। এই হাওরের আয়তন ১২ হাজার ৬৫৫ হেক্টর। হাওরে ছোট–বড় ১০৯টি বিল আছে। তবে প্রধান বিল ৫৪টি। হাওরের ভেতরে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অসংখ্য খাল ও নালা। বর্ষায় সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। তখন হাওর রূপ নেয় সমুদ্রে। হাওর এলাকায় ৮৮টি গ্রাম আছে। ১৯৯৯ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে 'প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা' ঘোষণা করার পর ৭০ বছরের ইজারাদারির অবসান হয়। ২০০০ সালে এটি 'রামসার সাইট' হিসেবে স্বীকৃতি পায় এবং ২০০১ সালে এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়। এরপর জেলা প্রশাসন হাওরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ##
Comments