কুমিল্লায় ভিসা প্রতারণা মামলার আসামীরা সৈয়দপুরে শ্রমিক-ভ্যানচালক! বিপাকে পরিবার
কানাডায় ছেলেকে পাঠানোর নামে কুমিল্লার দাউদকান্দির এক সৌদি প্রবাসীর স্ত্রীর প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি ভিসা প্রতারক চক্র। অথচ এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নীলফামারীর সৈয়দপুর ও কিশোরগঞ্জ উপজেলার ৮ জন নিরীহ ফ্যাক্টরী শ্রমিক, দিনমজুর ও রিক্সাভ্যান চালককে আসামী করা হয়েছে।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর অভিযোগ, প্রবাসীর স্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব পরিচিত এই এলাকার মোঃ ঈসা পূর্ব শ্রতুতার জেরে পরিবারের নির্দোষ লোকদের মামলায় জড়িত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আদালতের ওয়ারেন্টে ২ জনকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে এবং অন্যরা বাড়িছাড়া হয়েছেন। এ অবস্থায় হতদরিদ্র পরিবারগুলো পুলিশী হয়রানী ও মামলা নিয়ে বিপাকে পড়েছেন।
মামলার ঘটনাটি ঘটেছে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার লক্ষীপুর এলাকায়। এ ঘটনায় সৌদি প্রবাসীর স্ত্রী ফারজানা বেগম গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং সি.আর ১৩৪৩/২০২৪। এতে ৮ জনকে আসামী করা হয়েছে।
আসামীরা হলেন সৈয়দপুর উপজেলার খাতামধুপুর ইউপির কাচারীপাড়া এলাকার সেলিম হোসেন, মোতাবুল ইসলাম, আলমগীর হোসেন, সোনা মিয়া, আনিছুল হক ও ময়দানপুর এলাকার ওমর ফারুক এবং কিশোরগঞ্জ উপজেলার নয়নখাল ডাঙ্গাহাট এলাকার আকতারুল ও মনোয়ার হোসেন।
এই ৮ আসামীর বিরুদ্ধে মামলার বাদী ফারজানা বেগম তার ছেলেকে কানাডা পাঠানোর নামে ১৬ লাখ ৪৫০ টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করেছেন। এ টাকার মধ্যে নগদ ২ লাখ এবং ১৭টি বিভিন্ন বিকাশ নম্বরের মাধ্যমে ১৪ লাখ ৪৫০ টাকা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পরে আদালত গত ৩রা ফেব্রæয়ারী মামলাটি তদন্তের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেয়। ইতোমধ্যে পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে।
এদিকে আদালতের ওয়ারেন্টে সম্প্রতি পুলিশ আসামী সেলিম হোসেন ও সোনা মিয়াকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। ফলে মামলার বিষয়টি জানতে পারে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। স্থানীয়রাও মামলার অভিযোগ জেনে হতবাক হয়েছেন। তাদের কথা, দিনমজুর, ভ্যানচালকরা প্রতারণার সঙ্গে কোনভাবেই জড়িত নয়। প্রতারক চক্রই কৌশলে তাদের মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে।
সরেজমিনে খাতামধুপুর ইউপির কাচারীপাড়া এলাকার অভিযুক্তদের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, অভিযুক্তদের কেউ ফ্যাক্টরীর শ্রমিক, কেউ ভ্যানচালক, কেউবা রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের সবার বাড়িঘর জরাজীর্ণ, অন্যের জায়গায় থাকেন। এ সময় মামলায় আসামী সেলিম হোসেনের পিতা সৈয়দ আলী বলেন, সেলিম ঢাকায় রিক্সা চালায়। এছাড়া গ্রামে ধান কাটাসহ দিনমজুরের কাজ করেন। পারিবারিক দ্ব›েদ্বর কারণে ঈসা নামে এলাকার এক যুবকের ষড়যন্ত্রের শিকার সে।
মামলার ৬নং আসামী সোনা মিয়া ওরফে সাদেকের মা সোনালী বেগম কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমি আমার পুত্রকে নিয়ে অন্যের জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছি। আমার ছেলে সৈয়দপুরের একটি বিস্কুট ফ্যাক্টরীতে কাজ করে। এলাকার একটি পক্ষের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় তাকে মামলায় ফাঁসানো হয়েছে। অপর আসামী আলমগীর ইসলামের মা শেফালী জানান, তার পুত্র নারায়ণগঞ্জে একটি ডাইং ফ্যাক্টরীতে কাজ করেন।
অথচ ইমরান নামে ভুয়া ইমু দেখানো হয় তার নামে। মামলার বাদীর কাছে টাকা নেওয়ার যে অভিযোগ করা হয়েছে তা সত্য নয়। মামলার ২নং আসামী আক্তারুল বলেন, আমি ঢাকায় একটি গার্মেন্টসে কাজ করি। আমার নাম আক্তারুল হলেও ইমুতে নাম দেওয়া হয়েছে অনিল কাপুর। অথচ এসব বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। তিনি বলেন, মাইক্রোবাসে দাউদকান্দি যাওয়া, টাকা নিয়ে কানাডায় চাকুরি দেওয়ার ঘটনাগুলো সব মিথ্যা।
আসামী আনিছুল হকের স্ত্রী সাহিদা বলেন, তার স্বামী একজন ভ্যানচালক। তার ইমু বা অন্য একাউন্ট নেই। অথচ তাকে মামলায় জড়িত করা হয়েছে। মামলার বিষয়টি জানাজানি হলে এলাকাবাসী অবাক হয়ে যান। পরে প্রকাশ হয় ঘটনাটি ঈসা নামে এলাকার এক যুবকের চক্রান্ত।
এ ব্যাপারে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দারা মামলাটি অপরাধী চক্রের কারসাজি দাবি করে জানান, আসামীরা অভাবি। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষ। ভিসা প্রতারণায় জড়িত চক্রই নিজেদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রাখতে নিরীহ লোকদের মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। তারা আরও বলেন, কাচারিপাড়া এলাকার আবেদ আলীর পুত্র ঈসা নামের এক যুবকের সঙ্গে প্রবাসীর স্ত্রীর যোগাযোগ আছে।
এ নিয়ে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভুক্তভোগী পরিবার ও ঈসাকে ডেকে সালিশি বৈঠক করেন। জিজ্ঞাসাবাদে ঈসা মামলার কথা স্বীকার করেন এবং সমাধান করবেন বলে জানান। এরপর থেকে ঈসা রহস্যজনকভাবে বিষয়টি এড়িয়ে চলছেন।
স্থানীয়রা মামলাটি অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।এ ব্যাপারে খাতামধুপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জুয়েল চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বিষয়টি নিয়ে গত ১২ ও ১৫ অক্টোবর দুই দফা সালিশি বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে স্থানীয় যুবক ঈসা মামলার বিষয়টি সমাধান করবেন বলে আশ্বস্ত করেন। পরে তার সাথে কোন যোগাযোগ না হওয়ায় বিষয়টি ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। কথামত বিষয়টি সমাধান না করায় নিরীহ লোকজন বাড়ীছাড়া হয়ে হয়রানীর শিকার হচ্ছেন।
জানতে চাইলে, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুমিল্লা জেলা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) এর উপ-পরিদর্শক মো. ইব্রাহিমের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, মামলার তদন্ত করতে গিয়ে এ ঘটনায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তথ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের ভয়েস রেকর্ড অন্যান্য তথ্য মিলেছে। তিনি বলেন, তদন্ত শেষে প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে।
Comments