হাসনাতের বক্তব্য ‘অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার’: সেনাসদর

আওয়ামী লীগের 'সংশোধিত' একটি পক্ষের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে রাজি হতে সেনানিবাস থেকে চাপ পাওয়ার বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ যে দাবি করেছেন, তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে সেনাবাহিনী সদর দপ্তর।
শনিবার নেত্র নিউজকে দেয়া সেনাসদরের এক বিবৃতিতে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে যে, সেনানিবাসে খোদ সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গেই ১১ মার্চ বৈঠকটি হয়েছিল। তবে হাসনাত আব্দুল্লাহকে 'ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগে'র অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। বরং হাসনাত আব্দুল্লাহ ও তার দলের আরেক মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলমের আগ্রহেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে নতুন রূপে পুনর্বাসনের বিষয়ে সেনানিবাসের কাছ থেকে 'ভারতের পরিকল্পনা' উপস্থাপন করা হয়েছে — শুক্রবার হাসনাত আব্দুল্লাহর এমন ফেসবুক পোস্টে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল আলোচনার সৃষ্টি হয়।
এরই প্রেক্ষিতে নেত্র নিউজ যোগাযোগ করলে একজন মুখপাত্রের মাধ্যমে বক্তব্য দেয় সেনাসদর। হাসনাত আব্দুল্লাহর পোস্টকে 'সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়' বলেও মন্তব্য করা হয়েছে সেনা সদরের বিবৃতিতে। এছাড়া ২৭ বছর বয়সী এই ছাত্রনেতার বক্তব্যকে 'অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার' হিসেবেও আখ্যা দিয়েছে সেনাবাহিনী।
শুক্রবার এক ফেসবুক পোস্টে হাসনাত আব্দুল্লাহ দাবি করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী, জাতীয় সংসদের সাবেক স্পিকার শিরিন শারমিন ও ঢাকার মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসকে সামনে রেখে 'রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ' নামে নতুন একটি ষড়যন্ত্র নিয়ে আসার পরিকল্পনা চলছে'।
সুনির্দিষ্টভাবে তিনি বলেন, সেনানিবাস থেকে ১১ই মার্চ দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে এক বৈঠকে তাদেরকে এই নয়া আওয়ামী লীগকে মেনে নিতে সমঝোতা ও সংসদের আসন ভাগাভাগির প্রস্তাব দেয়া হয়।
তার পোস্টের পর ওই রাতেই জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। সেখানে নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদক হাসনাত আব্দুল্লাহকে প্রশ্ন করেন, সেনানিবাসে তিনি যে বৈঠকটির কথা বলছেন, তা কি সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে হয়েছিল কিনা। কিন্তু এই বিষয়ে তিনি সরাসরি জবাব দিতে অস্বীকৃতি জানান।
হাসনাত বলেন, 'আমিতো সেখানে 'ক্যান্টনমেন্ট' উল্লেখ করেছি, আপনারা কথা বলতে পারেন সেখানে'।
আরেকজন সাংবাদিক তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেন কার উদ্যোগে বৈঠকটি হয়েছিল। জবাবে হাসনাত বলেন, সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা ও বিদ্যমান আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্ন ছিল। এসব বিষয়ে 'কথা বলার জন্য আমাদেরকে আহ্বান জানানো হয়েছিল'।
সংবাদ সম্মেলনের পর নেত্র নিউজের একজন প্রতিবেদক আবারও বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি 'বাইনারি' বা হ্যাঁ-না জবাব দিতে রাজি হননি।
অপরদিকে নেত্র নিউজকে পাঠানো বিবৃতিতে সেনাসদর নিশ্চিত করে জানিয়েছে যে সেনাপ্রধানের সঙ্গেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল; তবে ওই বৈঠক ছাত্রনেতাদের আগ্রহেই হয়েছিল বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
বিবৃতিতে বলা হয়, 'হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং সারজিস আলম দীর্ঘদিন যাবৎ সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের জন্য ইচ্ছা পোষণ করছিলেন। পরবর্তীতে সারজিস আলম ১১ই মার্চ ২০২৫ তারিখে সেনাপ্রধানের মিলিটারি এডভাইজারকে ফোন দিয়ে সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের জন্য সময় চান। এর প্রেক্ষিতে মিলিটারি এডভাইজার তাদেরকে সেনাসদরে আসার জন্য বলেন'।
'অতঃপর ১১ই মার্চ দুপুরে সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনাসদরে না এসে সরাসরি সেনাভবনে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করেন। পরবর্তীতে সেনাপ্রধান অফিস কার্যক্রম শেষ করে সেনা ভবনে এসে তাদের সঙ্গে দেখা করেন'।
সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের বৈঠকে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছিল, তা নেত্র নিউজ স্বতন্ত্রভাবে নিশ্চিত করতে পারেনি। তবে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ ইউনিটের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পৃথকভাবে নেত্র নিউজকে বলেছেন যে, ছাত্রনেতাদের আগ্রহ ও উদ্যোগেই ওই বৈঠকটি হয়েছিল।
সেক্ষেত্রে হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের এই বৈঠক তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহে নাকি জাতীয় নাগরিক পার্টির পক্ষ থেকে পুর্বানোমোদিত ছিল, তা স্পষ্ট নয়।
তবে শনিবার সিলেটে এক ইফতার মাহফিলে দলটির আরেক নেতা নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী সহকর্মী হাসনাতের ওই ফেসবুক পোস্টকে 'শিষ্টাচার বর্জিত' হিসেবে উল্লেখ করেন।
এই বিষয়ে দলটির আহবায়ক নাহিদ ইসলাম ও সরজিস আলমের বক্তব্য চেয়েছে নেত্র নিউজ। তবে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তাদের জবাব পাওয়া যায়নি।
হাসনাত, সারজিস ও নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী — সকলেই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী কিংবা সেনাপ্রধানের সঙ্গে দূরত্ব বা রেষারেষির নেই উল্লেখ করে বক্তব্য দিয়েছেন।
হাসনাত আব্দুল্লাহ সেনানিবাসে ১১ মার্চের বৈঠকে হওয়া কিছু কথোপকথনকে উদ্ধৃত করে লিখেন যে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এই কথিত সংশোধিত আওয়ামী লীগকে মেনে নিয়েছে।
'আমাদেরকে প্রস্তাব দেওয়া হয় আসন [সমঝোতার] বিনিময়ে আমরা যেন এই প্রস্তাব মেনে নিই। আমাদেরকে বলা হয় - ইতোমধ্যে একাধিক রাজনৈতিক দলকেও এই প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে - তারা শর্তসাপেক্ষে আওয়ামী লীগ পুনর্বাসনে রাজি হয়েছে। একটি বিরোধী দল থাকার চেয়ে একটি দুর্বল আওয়ামী লীগসহ একাধিক বিরোধী দল থাকা না-কি ভালো'।
'আমাদেরকে আরো বলা হয় - রিফাইন্ড আওয়ামী লীগ যাদের দিয়ে করা হবে, তারা এপ্রিল-মে থেকে শেখ পরিবারের অপরাধ স্বীকার করবে, হাসিনাকে অস্বীকার করবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ করবে এমন প্রতিশ্রুতি নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হবে'।
আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে আলোচনা হওয়ার বিষয়টি সেনা সদরের বক্তব্যে অস্বীকার করা হয়নি। সেখানে বলা হয় আলোচনায় আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রসঙ্গ উঠে আসলে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান নিজের অভিমতের কথা ছাত্রনেতাদের জানান।
বিবৃতিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, 'আওয়ামী লীগের যেসব নেতারা ফৌজদারি মামলায় জড়িত নয় ও ক্লিন ইমেজের অধিকারী তাদের সমন্বয়ে নতুন আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, ফলপ্রসু ও আন্তর্জাতিক মহলে অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকার ও সব রাজনৈতিক দল মিলে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন বলে তিনি মত প্রকাশ করেন'।
আওয়ামী লীগের প্রসঙ্গে দেয়া বক্তব্য সেনাপ্রধানের নিজস্ব অভিমত হিসেবে আখ্যা দিয়ে ছাত্রনেতাদের উপর চাপ প্রয়োগের অভিযোগ বিবৃতিতে অস্বীকার করা হয়েছে।
'প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি কোনক্রমেই তাদেরকে ডেকে নিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয় নিয়ে তাদেরকে প্রস্তাব বা চাপ প্রয়োগ করার ঘটনা নয়', যোগ করা হয় সেনাসদরের বিবৃতিতে। 'বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মতো প্রতিষ্ঠিত সুশৃঙ্খল বাহিনীর প্রধান সদ্য প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের যুগ্ম সংগঠকদেরকে ডেকে নিয়ে আওয়ামী লীগের পুনর্বাসনের বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন বা চাপ প্রয়োগ করছেন যা অত্যন্ত হাস্যকর ও অপরিপক্ক গল্পের সম্ভার বলে প্রতীয়মান হয়'।
নিজের বহুল আলোচিত ফেসবুক পোস্টে 'অপরপক্ষের' সুনির্দিষ্ট বক্তব্যকে উদ্ধৃত করে হাসনাত আব্দুল্লাহ লিখেছিলেন: "আলোচনার এক পর্যায় বলি - যেই দল এখনো ক্ষমা চায় নাই, অপরাধ স্বীকার করে নাই, সেই দলকে আপনারা কিভাবে ক্ষমা করে দিবেন! অপরপক্ষ থেকে রেগে গিয়ে উত্তর আসে, 'ইউ পিপল নো নাথিং। ইউ ল্যাক উইজডোম এন্ড এক্সপিরিয়েন্স। উই আর ইন দিজ সার্ভিস ফর এটলিস্ট ফোর্টি ইয়ার্স। (তোমরা কিছুই জানো না। তোমাদের প্রজ্ঞা ও অভিজ্ঞতার অভাব আছে। আমরা চাকরিতে আছি কমপক্ষে ৪০ বছর ধরে।) তোমার বয়সের থেকে বেশি। তাছাড়া আওয়ামী লীগ ছাড়া 'ইনক্লুসিভ' (অংশগ্রহণমূলক) ইলেকশন হবে না।"
অপরদিকে সেনাসদরের বক্তব্যে বলা হয়, এই দুই ছাত্র সমন্বয়ককে সেনাবাহিনী প্রধান 'অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে ছেলের' মতো দেখতেন। বিবৃতিতে বলা হয়, 'তিনি [স্নেহবৎসল] পরিবেশে তাদের সঙ্গে নানা আলাপচারিতা করেন। প্রাসঙ্গিকভাবে তাদের নতুন দল গঠনের শুভকামনা ও পরবর্তী রাজনৈতিক পথ চলার বিষয়ে নানা প্রসঙ্গে আলাপ করেন'।
'এছাড়াও পরবর্তী নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি তাদের রাজনৈতিক দলের প্রস্তুতি, অংশগ্রহণ ও অন্যান্য সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত সকল দলের অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে ব্যাখ্যা করেন,' যোগ করা হয় বিবৃতিতে। 'সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে দেখা করার ১০ দিন পর ফেসবুকে হাসনাত আব্দুল্লাহর এই ধরনের অনভিপ্রেতকর পোস্ট দেওয়া সম্পূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বৈ অন্য কিছু নয়'।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশটির সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। ওই সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ এবং পরবর্তীতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনে তার ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে বহু রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সেনাবাহিনী ও এর জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ভূমিকা ছিল। ঐতিহাসিকভাবেই দেশটিতে এখনও রাজনীতি ও বিভিন্ন বেসামরিক কার্যক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর প্রভাব লক্ষ্যনীয়। তবে শেখ হাসিনার পতন পরবর্তী সময়ে বারবার কোনো ধরণের সেনা হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা বা আগ্রহ উড়িয়ে দিয়েছেন সেনাবাহিনীতে মৃদুভাষী হিসেবে পরিচিত জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
কিন্তু তারপরও সেনাবাহিনীর অবস্থান ও ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পক্ষের মধ্যে বিদ্যমান অস্বস্তি চাপা দিয়ে রাখা যায়নি।
(লেখাটি ঢাকা জার্নাল পাঠকের জন্য সরাসরি নেত্র নিউজ থেকে নেয়া)
Comments