বালুচ লিবারেশন আর্মী কে বা কারা?

পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী বেলুচিস্তানে যাত্রীবাহী ট্রেন জাফর এক্সপ্রেসে সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে জিম্মি যাত্রীদের উদ্ধারে অভিযান চালাচ্ছে। ইতিমধ্যে অন্তত শতাধিক যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সশস্ত্র গোষ্ঠীর অন্তত ১৬ সদস্য নিহত হয়েছেন। নিরাপত্তাবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যও মারা গেছে, তবে এখনও ক্রন সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি।
গত চব্বিশ ঘণ্টায় বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত নাম এই জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন। এর আগেও এই জাফর এক্সপ্রেসকে টার্গেট করেছিল স্বাধীনতাপন্থী সশস্ত্র বালুচ গোষ্ঠী বালুচ লিবারেশন আর্মি – বিএলএ'র বিদ্রোহীরা। প্রশ্ন উঠছে, কারা এই বিএলএ? গত কয়েক মাসে পাকিস্তানে বিএলএ তাদের তৎপরতা বাড়িয়েছে, একের পর এক হামলা করছে, সেসব হামলা থেকে সামরিক স্থাপনাও বাদ যাচ্ছে না। নিরাপত্তা বাহিনীর পাশাপাশি মারা যাচ্ছে নিজেদের সদস্যসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ।
পাকিস্তানের সব থেকে বড় প্রদেশ বালুচিস্তান। স্বাধীনতার লড়াই করছে দেশটির জনগণ। আর সেই স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করছে বিএলএ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই আলাদা হওয়ার দাবি জানিয়েছে বালুচিস্তান। ২০০০ সালের শুরুর দিকে এই প্রদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করার দাবিতে পাক সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে বিএলএ। তারপর থেকে পাকিস্তানি শাসনের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে লড়াই চালাচ্ছে বালুচ বিদ্রোহীরা। বিএলএ-কে ঠেকাতে গুমখুন, হত্যা ও ধর্ষণের মতো অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে ইসলামাবাদ। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি হওয়ার পর থেকেই আরও অশান্ত হয়ে উঠেছে বালুচিস্তান। অভিযোগ, খনিজ সমৃদ্ধ প্রদেশটিকে কার্যত লুট করছে পাক প্রশাসন। প্রতিদানে বালুচ জনতা পাচ্ছে শুধুই নির্যাতন ও দারিদ্র।
১৯৪৮ সালে 'কালাত চুক্তি'র মাধ্যমে বেলুচিস্তানকে নিজেদের সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে সংযুক্ত করে পাকিস্তান। এ চুক্তি অনুসারে কেবল প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতি ইসলামাবাদের হাতে থাকার কথা নির্ধারিত হয়। বাকি বিষয়গুলো বেলুচিস্তানের শাসকদের ওপর ন্যস্ত রাখার সিদ্ধান্ত স্থির করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালে জিন্নাহর সঙ্গে বেলুচিস্তানের শাসকদের হওয়া এই চুক্তিটি পরবর্তী সময়ে অগ্রাহ্য করে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী। তাতে করে শোষণে জর্জিত বাঙালিদের মতোই বালুচরা প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। আর তা দমনে সামরিক বলপ্রয়োগ করে অঞ্চলটি দখল করে নেয় পাকিস্তানি শাসকরা। পাকিস্তানের অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বালুচরা প্রতিবাদী হয়ে উঠলে শোষকদের সামরিক আগ্রাসন শুরু হয়। তখন থেকে গুম-হত্যা-নির্যাতনের এক অভয়ারণ্যে পরিণত হয় প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ বেলুচিস্তান। অন্যদিকে নিজেদের অধিকার ও নিয়ন্ত্রণ হারানোর বিষয়টি মেনে নিতে পারেনি বালুচররা; প্রতিবাদ আর স্বাধীনতার দাবিতে আটচল্লিশ সালের পর থেকেই তারা সংগঠিত হতে থাকে।
স্বাধীন বালুচ ভূমি প্রতিষ্ঠার অন্যতম লড়াকু সংগঠন বিএলএ। বিএলএ-এর নেতৃত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বদের মধ্যে আসলাম বালুচের কমান্ডার ছিলেন, যিনি ২০১৮ সালে আফগানিস্তানে এক আত্মঘাতী হামলায় নিহত হন। বিএলএ মূলত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অন্যান্য প্রতিবেশি দেশে ঘাঁটি গেড়ে অপারেশন পরিচালনা করছে। প্রায় দুই দশক ধরে পাকিস্তানকে রক্তাক্ত করছে বালুচ বিদ্রোহীরা। চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)- এর সঙ্গে যুক্ত প্রকল্পগুলোই মূলত লক্ষ্য থাকে বিএলএ-এর। একাধিকবার বিদ্রোহীদের হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন বহ চীনা নাগরিক, যারা এই প্রকল্পগুলোতে কাজ করার জন্য পাকিস্তানে এসেছিলেন। এছাড়া খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশের দক্ষিণ প্রদেশগুলোকেও উত্তপ্ত করে রেখেছে বালুচ বিদ্রোহীরা।
২০১৮ সালে করাচির চীনা দূতাবাসে হামলা হয়, যার দায় নেয় বিএলএ। এরপর গদরে চীনের প্রকৌশলীদের টার্গেট করে একটি বিলাসবহুল হোটেলে হামলা চালায় বালুচ বিদ্রোহীরা। এছাড়া বিভিন্ন রেল স্টেশন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে নাশকতা করে বিএলএ। সাম্প্রতিক সময়ে গত বছরের নভেম্বরে বালুচিস্তানের রাজধানী কোয়েটার রেল স্টেশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ হয়। প্রাণ হারান বহু মানুষ। সেই হামলারও দায় স্বীকার করে বিএলএ।
স্বাধীনতার জন্য লড়লেও জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে বিএলএ। পাকিস্তান সরকার তো বলছেই, ব্রিটেন এবং আমেরিকা বিএলএকে জঙ্গি সংগঠনের তকমা দিয়েছে। ২০১৯ সালে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রক নাগরিক এবং নিরাপত্তা কর্মীদের উপর হামলার কথা উল্লেখ করে এই গোষ্ঠীটিকে বিদেশী সন্ত্রাসী সংগঠনের (এফটিও) তালিকাভুক্ত করে।
Comments