সরকার কেন গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়?

বুধবার শিল্প খাতে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে আয়োজিত শুনানিতে হট্টগোল হয়েছে। ভোক্তা ও ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা গ্যাসের দাম বাড়ানো তীব্র বিরোধিতা করেছেন। শুনানি শুরুর আগে এটি বাতিলের দাবিতে মানববন্ধনও হয়েছে। এরপর শুনানি চলাকালে স্লোগানে স্লোগানে আপত্তি জানান সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা। দাম বাড়ানোর প্রক্রিয়া বাতিল করে দাম কমানোর শুনানি আহ্বান করার দাবি জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো।
এর আগেও ব্যবসায়ী নেতারা বিরোধিতা করে বলেছেন গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্প টিকবে না। কিন্তু সরকার কেন এমন এক সময়ে গ্যাসের দাম বাড়াতে চায়? সরকারের যুক্তি হলো জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমাতে ও তরলীকৃত প্রাকৃতি গ্যাসের বাড়তি আমদানি খরচ মেটাতে দাম বাড়াতে হবে।
গত ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে শিল্প খাতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। এতে শিল্পে নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। তবে পুরোনোদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। এবং এই প্রস্তাবনা নিয়েই বুধবার শুনানি হয়েছে।
গত ২৫ জানুয়ারি এক সেমিনারে দেয়া বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খানের বক্তব্যে ধারণা পাওয়া যায় সরকারের আবস্থানের। তিনি সেদিন বলেছিলেন, 'বিদ্যুতের দাম, গ্যাসের দাম বাড়ানোর চাপ আছে। গ্যাসের দাম বাড়ানোর জন্য 'ট্রিমেন্ডাস প্রেসার' (ব্যাপক চাপ) আছে'। কিন্তু কারা এই চাপ দিচ্ছে সরকার সেটা পরিষ্কার করছে না। বুধবারের শুনানিতে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) –এর জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম জানতে চেয়েছেন, শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে ৭৫ দশমিক ৭২ টাকায় বৃদ্ধির পেছনে কারা রয়েছেন? কারা এমন চাপ দিচ্ছে যাতে আমাদের শিল্পখাত রপ্তানি বাজার থেকে ছিটকে পড়ে? কোন উত্তর আসেনি।
পেট্রোবাংলা দুটি উৎস থেকে গ্যাস সংগ্রহ করে। দেশীয় উৎস হলো বিভিন্ন কোম্পানি। এতে প্রতি ইউনিটে তাদের গড়ে খরচ হয় ৬ টাকা ৭ পয়সা। কিন্তু তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে খরচ হচ্ছে ৭৫ টাকার বেশি। এতে লোকসানে আছে সংস্থাটি। ভর্তুকি দিতে রাজি নয় সরকার। তাই এখন এলএনজি আমদানির খরচ পুরোটাই শিল্পের ওপর চাপাতে চাইছে পেট্রোবাংলা। সংস্থাটি বলছে, এলএনজি আমদানি করে চলতি অর্থবছরে (২০২৪-২৫) ১৬ হাজার ১৬২ কোটি টাকা ঘাটতি হতে পারে।
সরকার গ্যাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে পারছে না, কিন্তু সময়ে সময়ে দাম বাড়াচ্ছে। একটা বড় শঙ্কার জায়গা হলো বিনিযোগ। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিল্পায়নকে নিরুৎসাহিত করবে। শিল্পে নতুন বিনিয়োগ আসবে না, কর্মসংস্থানও হবে না। বিদেশি বিনিয়োগও আসবে না।
বাস্তবতা হলো,গ্যাস সংকট আছে এবং দিন দিন তা বাড়ছে। পেট্রোবাংলার হিসেবে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দিনে অনুমোদিত লোড ৫৩৫ কোটি ঘনফুট। এর বিপরীতে দিনে ৩৮০ থেকে ৪০০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা আছে। সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয় ২৮০ থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুট। এতে ঘাটতি থাকছে দিনে ১০০ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট। যদিও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়ে দিনে সরবরাহ করা হয়েছে ২৪৯ কোটি ঘনফুট।
এর অর্থ হলো দাম বাড়লেও গ্যাসের সরবরাহ বাড়বে না। কারণ দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন ক্রমে কমছে। এটা দ্রুত বাড়ানোর সুযোগ নেই। এলএনজি থেকে সর্বোচ্চ আমদানির সক্ষমতা ১১০ কোটি ঘনফুট। নতুন এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ না হলে আমদানি আর বাড়ানো যাবে না। আগামী দুই বছরেও নতুন টার্মিনাল চালুর তেমন সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল নির্মাণে কোনো চুক্তিও হয়নি। এ ছাড়া এই আমদানিতে যে বৈদেশিক মুদ্রা করচ হবে সেটা নিয়েও বাবনা আছে।
প্রস্তাবিত দাম শিল্পের জন্য খুবই কঠিন হবে। এই দামে গ্যাস কিনে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকতে পারবে না। গ্যাসনির্ভর স্থানীয় কারখানায় উৎপাদিত পণ্যের দামও বাড়বে এতে। তাই সরকারকে ভিন্ন চিন্তা করতে হবে। গ্যাস খাতে থেকে মুনাফা করার ভাবনা বাদ দিতে হবে।
Comments