হার্ট অ্যাটাক হলে জীবন বাঁচাতে ‘সিপিআর’ কেন জরুরি

হার্ট অ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিক রোগীর হৃৎপিণ্ড রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করে থাকে সিপিআর। এটি হৎপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখার জন্য ম্যানুয়ালি পাম্প করে কাজ করে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে আবার ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছে দেয়ার জন্য উদ্ধারকারী শ্বাস প্রদান করে থাকে। সিপিআরের দুটি প্রধান উপাদান। বুকের সংকোচন এবং বায়ুচলাচল (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে)।
বুকের সংকোচন: সিপিআরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে বুকের সংকোচন। যা প্রতি মিনিটে প্রায় ১০০-১২০ কম্প্রেশনের হারে বুকের কম্প্রেশন প্রয়োগের মাধ্যমে করা হয়। এ কাজটি মস্তিষ্ক ও হৃদয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিতে রক্ত সঞ্চালনে সহায়তা করে থাকে। হার্ট অ্যাটাক হলে তখন রক্ত প্রবাহ বজায় রাখতে গভীর এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ চাপের প্রয়োজন হয়।
উদ্ধার শ্বাস: কিছু সিপিআর উদ্ধার শ্বাস-প্রশ্বাসের কৌশলগুলো ব্যবহার হয়। বিশেষ করে শিশু ও শিশুদের ক্ষেত্রে। উদ্ধারকারী তার বা তার মুখটি শিকারের মুখ এবং নাকের উপর রাখে এবং শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ করতে শ্বাস প্রদান করে থাকে। তবে কখনো শুধু বুকের সংকোচনই যথেষ্ট এবং উদ্ধারকারী শুধু ম্যানুয়াল সিপিআর সম্পাদন করে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষ কখনো সমানভাবে কার্যকর হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে এটি।
এদিকে হার্ট অ্যাটাক হলে সিপিআর কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং কখন দিতে হবে, তা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা। এবার তাহলে এ সম্পর্কে আরও জেনে নেয়া যাক।
সিপিআর কখন দিতে হবে: ব্রিটিশ হার্ট ফাউন্ডেশনের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, আপনার সামনে যদি কারো কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়, তাহলে তাৎক্ষণিক জরুরি সেবা নম্বরে ফোন করুন এবং তাকে সিপিআর দেয়া শুরু করুন।
যুক্তরাজ্যের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা বিভাগও প্রায় একই কথা জানিয়েছে। তাদের ভাষ্য―কেউ অজ্ঞান হলে এবং স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস না নিলে জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করতে হবে এবং তাকে সিপিআর দেয়া শুরু করতে হবে।
রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট বিশ্বজুড়ে স্বেচ্ছাসেবীদের প্রাথমিক চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রেড ক্রসের ভাষ্য অনুযায়ী, কেউ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হলে তার জীবন রক্ষায় সহায়তা করে থাকে সিপিআর বা কার্ডিওপালমোনারি রিসাসিটেশন। হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হলে বা হার্টবিট নিয়মিত না হলে তখন মস্তিষ্ক ও অন্যান্য জরুরি প্রত্যঙ্গে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া একদমই স্বাভাবিক থাকে না। এ কারণে মস্তিষ্কের উপর প্রভাব ফেলে তা। ফলে অনেক সময় ব্যক্তির মৃত্যুও হতে পারে। তবে সিপিআর দেয়া হলে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা থাকে।
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের হৃদরোগ ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. আশরাফ উর রহমান তমাল বলেন, কার্ডিয়াক রোগীরও হতে পারে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। আবার নন কার্ডিয়াক পেশেন্ট বা যাদের হৃদরোগ নেই, তাদেরও কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে।
কেউ জোরে আঘাত পেলে বা পড়ে গেলে, যদি হার্ট বন্ধ হচ্ছে দেখা যাচ্ছে, ওই ব্যক্তি মাটিতে শুয়ে বা লুটিয়ে পড়েন, তখন তাকে সিপিআর দেয়া হলে জীবন রক্ষার সময় পাওয়া যায়। হৃদরোগ থেকে যেমন এ ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে, আবার ইলেকট্রিক শক, প্রচণ্ড আঘাত, পানিতে ডুব এবং শরীরে বড় ধরনের ইনফেকশন থাকলেও হতে পারে। এসব কারণেও হৃদযন্ত্র স্বাভাবিক কাজ করা বন্ধ করে দিয়ে থাকে। এ পরিস্থিতিতে সবসময় জরুরি ভিত্তিতে সিপিআর দেয়ার কথা বলেন চিকিৎসকরা।
ডা. আশরাফ বলেন, হার্ট যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে খুব অল্প সময় দিয়ে থাকে, ৫-৭ মিনিট, তারপর যদি ফের হার্ট ফিরেও আসে তখন রোগীর মস্তিষ্ক ডেথ হয়ে যায়। এ কারণেই সিপিআর দ্রুত একদম প্রথম অবস্থায়ই দেয়া জরুরি বলে মনে করেন এ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
সিপিআরের সাত ধাপ: সিপিআরের সাতটি ধাপের কথা জানিয়েছে রেড ক্রস। এতে প্রথম ধাপেই নিরাপত্তার বিষয় বলা হয়েছে। অর্থাৎ, রোগীর আশপাশে আগুন-পানির মতো কোনো বিপদ রয়েছে কিনা, রাস্তার মাঝে কিনা ইত্যাদি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। প্রয়োজন সাপেক্ষ পিপিই বা পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট ব্যবহারের করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপে রোগী সাড়া দেয় কিনা সেটি দেখতে হবে। এ জন্য রোগীর গায়ে ধাক্কা দিয়ে তাকে জোরে জোরে ডাকতে হবে। একইসঙ্গে পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত হতে হবে যে, তার কোনো রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা। যদি কোনো সাড়া না পাওয়া যায় এবং নিঃশ্বাস না নেয়, পালস না থাকে বা ঘড়ঘড় করে, তাহলে তৃতীয় ধাপে সহায়তা চাইতে হবে ও জাতীয় জরুরি সেবার নম্বরে ফোন করতে হবে।
চতুর্থ ধাপে হাঁটু গেড়ে বসতে হবে রোগীর পাশে। এ সময় তার হাত কাঁধ বরাবর সামনে রাখতে হবে এবং ওই ব্যক্তিকে সমান জায়গায় চিৎ করে শুইয়ে দিতে হবে। আর পরবর্তী ধাপ, অর্থাৎ পঞ্চম ধাপে শুরু হবে মূল সিপিআর। এ জন্য প্রথমেই রোগীর বুকের ওপর দুটো হাত প্রতিস্থাপন করতে হবে। এক হাতের ওপর আরেক হাত রেখে দুই হাতের আঙুলগুলো ধরে তালু দিয়ে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এ সময় খেয়াল রাখতে হবে, এই চাপ যেন অন্তত দুই ইঞ্চি গভীরে যায়। প্রতিবারই চাপ দেয়ার পর ছেড়ে দিতে হবে, যাতে করে আবার আগের অবস্থানে চলে আসে বুক। আর এর গতি থাকবে মিনিটে ১০০ থেকে ১২০ বার। এভাবে টানা ৩০ বার চাপ দেয়ার পর একটা বিরতি নিন।
এখন শুরু হবে ষষ্ঠ ধাপ, অর্থাৎ মুখ দিয়ে নিঃশ্বাস দেয়া। এ জন্য মাথা সোজা রেখে থুতনিতে চাপ প্রয়োগ করে উপরে ঠেলে দিতে হবে। তারপর মুখ হাঁ করাতে হবে। এরপর ওই ব্যক্তির নাক ধরে একটা স্বাভাবিক দম নিয়ে তার মুখে মুখ চেপে শ্বাস দিতে হবে। যার স্থায়িত্ব এক সেকেন্ড হবে। এই সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে রোগীর বুক একটু ফুলে উঠে। এবার পরের শ্বাস দেয়ার আগে মুখ উঠিয়ে তা বের হওয়ার সুযোগ দিতে হবে।
এ ক্ষেত্রে প্রথমবার বুকের উঠানামা না হলে রোগীর মাথা ফের নাড়িয়ে নিয়ে মুখ খুলে দেখে নিতে হবে, রোগীর গলায় বা মুখের ভেতরে কোনো কিছু আটকে রয়েছে কিনা, যে কারণে নিঃশ্বাসের ক্ষেত্রে বাধা পাওয়া যাচ্ছে।
সবশেষ সপ্তম ধাপে ফের এভাবে ৩০ বার বুকে চাপ দেয়া চালিয়ে যেতে হবে। আবারও মুখে দু'বার নিঃশ্বাস দিতে হবে এবং অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, বুকে চাপ দেয়ার বিরতি ১০ সেকেন্ডের বেশি যেন না হয়। আর হাসপাতালে নেয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স না আসা বা সহায়তা না পাওয়া পর্যন্ত এভাবে সিপিআর চালিয়ে যেতে হবে।
Comments