ফোন স্ক্রলিংয়ের নেশা থেকে মুক্তি পেতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
বর্তমান সময়ে প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন রয়েছে। এসব স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর অধিকাংশই আবার কাজের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা অবসরে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যমে স্ক্রলিং করে সময় কাটিয়ে থাকেন। সামনে আসা কুকুর-বিড়ালছানার ভিডিও, পুরনো কোনো বন্ধুর পাহাড়-সমুদ্রপাড়ে তোলা ছবি, চলমান কোনো ইস্যু নিয়ে তৈরি ভিডিও মিমস কিংবা কোনো খবর ভেসে আসলে তাতে চোখ রাখা হয়। আর তা যদি ভালো লাগে তাহলে দেখা হয়, না লাগলে স্ক্রল করে অন্যটি দেখা হয়।
স্ক্রিনে এভাবে চোখ রেখে একের পর এক স্ক্রলিং করে সময় কাটানো এখন অনেকেরই দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এভাবেই দেখা যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে গেছে। কিন্তু এই স্ক্রলিং এতটা আসক্তিকর কেন? এটি স্নায়ুর ওপর কোনো প্রভাব ফেলে কী? এ সমস্যা কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়―এসব তুলে ধরা হয়েছে বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী লিডস বেকেট ইউনিভার্সিটির সাইকোলজি বিভাগের সিনিয়র লেকচারার এইলিশ ডিউক জানিয়েছেন, প্রথমে যা বুঝতে হবে, ফোন হাতে নিয়ে স্ক্রিন অন করা, এরপর স্ক্রলিং চালিয়ে যাওয়া অটোমেটিকভাবে একের পর এক ঘটে যায়। যা নিজেরাও বুঝতে পারেন না। কারণ এটি অনেক দিনের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টা এমন যেন অনেকটা বাসা-বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় দরজা বন্ধ করার মতো।
এ অধ্যাপক বলেন, কয়েক বছর আগে একটি গবেষণা চালিয়েছিলাম আমরা। এতে অংশগ্রহণকারীদের ধারণা ছিল, প্রতি ১৮ মিনিটে একবার ফোন চেক করেন তারা। কিন্তু স্ক্রিন রেকর্ডিং ব্যবহারের পর দেখা গেছে, তারা আরও ঘন ঘন ফোন হাতে নিয়ে থাকেন।
স্ক্রিনের আলো জ্বলে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই ফোনের অ্যাপ্লিকেশনগুলোর অত্যাধুনিক ডিজাইন ও মস্তিস্কের মধ্যে যেন একটা মেলবন্ধন হয়ে যায়। যা সক্রিয় করে তোলে মস্তিষ্ককে।
এন ওয়াই ইউ ল্যাঙ্গনের সাইকিয়াট্রির অধ্যাপক আরিয়েন লিংয়ের ভাষ্যমতে―আমরা স্ক্রলিংয়ের মতো এ ধরনের অভ্যাসের জন্য মানুষের স্বভাবকে দায়ী করে থাকি। কিন্তু এই অভ্যাসের মাত্রা পরিবেশগত কারণেও বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। এ অধ্যাপক ব্যাখ্যা হিসেবে জানিয়েছেন, মানুষ স্বভাবগত কারণেই কৌতূহলী। তার চারপাশে কখন কী ঘটছে, এসব জানার জন্য বেশ আগ্রহ থাকে। এ কারণে তারা খবর পড়ে, রাস্তায় কখনো দুর্ঘটনা ঘটলে থেমে যায়। যা বিবর্তনের অংশ। এ কারণেই টিকে আছে মানবজাতি। ফোন তৈরিই করা হয়েছে এমনভাবে, যেন মানুষের প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
সুখানুভূতির সন্ধান: মানুষের মস্তিষ্ক পুরস্কারপ্রিয়। স্নায়ুতন্ত্রের নির্দিষ্ট কিছু জায়গার কাজ হচ্ছে মাদক, জুয়া ও যৌনতার মতো আনন্দ অনুভূতি নিয়ে। একবার এ ধরনের সুখানুভূতি পেলে মস্তিষ্কব এটি বারবার পেতে চায়। অধ্যাপক ডিউকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, সত্যিই যদি আমরা কিছু উপভোগ করে থাকি, তাহলে আমাদের মস্তিষ্ক সেই অনুভূতি চায়, সেই সুখের অনুভূতি চায়।
এটি হচ্ছে মস্তিষ্কের রিওয়ার্ড সিস্টেম (পুরস্কার ব্যবস্থা) নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়াই কোনো ব্যক্তিকে অ্যালকোহলের মতো আসক্ত করে ফেলে। আর অনেক মানুষের ক্ষেত্রেই এ ধরনের অভিনবত্ব নিয়ে এসে থাকে ফোন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে প্রায়ই কিছু না কিছু সুখানুভূতি উপাদান থাকে, যেমন একটি ছবি বা ভিডিও, টুইট বা মেসেজ ইত্যাদি।
এদিকে মস্তিষ্কের অনেক অংশ আছে, যা সুখানুভূতি ও তাৎক্ষণিক পুরস্কারের এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে চায়। সামনের দিকের এই অংশের নাম প্রিফ্রন্টাল কর্টেক্স। মস্তিষ্কের এই অংশ মানুষের আবেগপ্রবণতা রুখে দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে। এ জন্য স্ক্রলিং থামানো বা কাজহীন বসে না থেকে বাসা-বাড়ির কাজ করতে পারেন। তবে মস্তিষ্কের দুই ধরনের ক্রিয়াকর্মের মধ্যে ভারসাম্য সবসময় বজায় থাকে না।
অধ্যাপক ডিউকের ভাষ্য অনুযায়ী, যারা ফোনের স্ক্রিনে ডুবে থাকেন, এদের মস্তিষ্কের যুক্তিনির্ভর অংশ, যা আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে, তা ঠিকঠাক মতো কাজ করে না। মূলত তারা সুখানুভূতির আকাঙ্ক্ষায় আচ্ছন্ন থাকেন। যা বেশি হয় তরুণদের ক্ষেত্রে।
স্ক্রলিংয়ের আকর্ষণ এড়ানোর উপায়:
নির্দিষ্ট সময় স্ক্রিন থেকে দূরে থাকা: এ ব্যাপারে অধ্যাপক লিং বলেন, ফোন থেকে নিজেকে দূরে রাখার এই চেষ্টা অনেকটাই কাজে আসে। ফোন রেখে বা ছাড়া বাইরে হাঁটতে বের হওয়ার উপকারিতা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। এছাড়া অধ্যাপক ডিউকও একমত যে, ফোন দূরত্বে রেখে বিরতি নিতে পারলে তা দারুণ হয়। আর এই সময়টায় হাঁটাহাঁটি বা জিমে যাওয়া যেতে পারে।
বাস্তবতার সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানো: ফোনের মাধ্যমে হয় এ ধরনের কাজগুলো ফোন ছাড়া করার চেষ্টা করলে আপনাআপনিই স্ক্রলিং করা অনেকটা স্বাস্থ্যকর উপায়ে সম্ভব। অধ্যাপক ডিউক বলেন, আমরা কয়েক বছর আগে এক গবেষণায় দেখেছি, যারা সাধারণ ঘড়ি ব্যবহার করেন, আর যারা সেল ফোনে সময় দেখেন, তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। ইচ্ছাকৃতভাবে না হলেও যারা ফোনে সময় দেখেন, তারা স্ক্রলিংয়ে আটকে যান। যেমন, কিছু একটা পড়ার সময় সেটি অনলাইনে না থেকে যদি পড়া সম্ভব হয়, তাহলে সেটি দারুণ ব্যাপার।
গতিপথে পরিবর্তন আনা: কোনো সফটওয়ার বা অ্যাপ্লিকেশনে প্রবেশ করা বা সেটি ব্যবহারের সময় কখনো কি আমরা ভাবি, এটা কেন করছি? এ ক্ষেত্রে আমরা অধিকতর সচেতন হতে পারলে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অধ্যাপক লিং বলেন, ফোন হাতে নেয়ার অভ্যাস অনেকটা ক্ষুধার মতো। নিজে বোঝা যায় কখন ক্ষুধা লেগেছে। ফোনের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক জানান দেয়, দীর্ঘক্ষণ তো হলো ডোপামিন নিঃসরণ হয়নি, এবার তাহলে চলো, শুরু করা যাক। এরপরই ক্ষুধা ঢেউয়ের মতো বেড়ে যেতে পারে। তবে আপনি চাইলে এই তাগিদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। নিজেকে আপনি বলতে পারেন, বুঝতে পেরেছি ফোন দেখতে ভীষণ ইচ্ছা করছে। কিন্তু ফোন তো না দেখলেও পারি।
Comments