মোবাইল স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে শিশুদের যেসব ক্ষতি হচ্ছে
জন্মের পর থেকেই সময়ের সঙ্গে বেড়ে উঠে শিশু। তার শারীরিক পরিবর্তনের সঙ্গে মানসিক বিকাশ হয়। শিশুর বৃদ্ধি একটা ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। ৭ থেকে ৮ মাস বয়সেই দাদা,বাবা, আম্মা এই ধরণের শব্দ বলে। সময়ের সঙ্গে সে পূর্ণ বাক্য বলতে পারে। ৭ থেকে ৮ মাস বয়সেই দাদা,বাবা, আম্মা এই ধরণের শব্দ বলে। বেশিরভাগ সময় দুই থেকে আড়াই বছরের মধ্যে শিশুরা ভালোভাবে কথা বলে মনের ভাব প্রকাশ করে। তবে যখন এই সময়ের পরেও শিশু কথা বলতে পারে না তার পরিবারের সদস্যদের উদ্বিগ্নতা বেড়ে যায়। তবে তারা অনেকেই এর পেছনে স্ক্রিনের প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব দেন না।
বর্তমান সময়ে অনেক শিশু ডিভাইসে আসক্ত। মোবাইল, ট্যাব, টেলিভিশন, ল্যাপটপে তারা অতিরিক্ত সময় দেয়। গবেষণা থেকে জানা যায় অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইম শিশুর কথা বলা শিখতে দেরি হওয়ার কারণ। চ্যানেল 24 অনলাইনের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন সাইকোলজিস্ট সূরাইয়া ইসলাম মুন্নি।
স্ক্রিন টাইম বেশি হলে শিশুদের যোগাযোগের সমস্যা হয় আর এ থেকেই তাদের ভাষার বিকাশে প্রভাব ফেলে। তিন বছর বা তার নিচের শিশুরা স্ক্রিন টাইমের মাধ্যমে অন্যের সঙ্গে কথা বলা শিখতে পারে না। কারণ কথা বলার সময় দুইজন বা তার বেশি মানুষ তথ্যের আদান-প্রদান করে থাকে। কিন্তু ইলেকট্রনিক ডিভাইসের বিভিন্ন ভিডিও একাই চলে (একমুখী) যা দেখে শিশু কখনোই অন্যের সাথে তথ্যের আদান-প্রদান করা শিখতে পারে না। যে সব শিশুর বয়স ২ থেকে ৩ বছরের ভিতরে তারা যদি প্রতিদিন ২ ঘণ্টার বেশি সময় ধারে স্ক্রিন দেখে সেক্ষেত্রে তাদের ভাষার বিকাশ অন্য শিশুদের (যারা কম সময় নিয়ে স্ক্রিন দেখে বা স্ক্রিন একদমই দেখে না) তুলনায় পিছিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
এমনকি যে সব বাবা মায়েরা নিজেরা বেশিরভাগ সময় ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তারা তাদের সন্তানের কি প্রয়োজন বা কি প্রয়োজন নয় তা খেয়াল করতে পারে না। ফোনে মনোযোগ দেয়ায় বাবা- মা শিশুর সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলে না ফলে শিশু বয়স অনুযায়ী কথাও শিখতে পারে না। ২০১৯ ও ২০২১ এর একটি গবেষণা অনুযায়ী যে সব সন্তানের বাবা মা বিষণ্নতায় (ডিপ্রেশনে) ভুগছেন বা মানসিক চাপে আছেন তাদের সন্তানেরা তুলনামূলক বেশি স্ক্রিন দেখে সময় কাটায়।
শিশু কত সময় নিয়ে স্ক্রিন দেখছে তার সঙ্গে আরো একটি বিষয় জড়িত আর সেটা হলো শিশু কেমন পরিস্থিতিতে স্ক্রিন দেখছে। যেমন, যে শিশু টেলিভিশনে কিছু দেখছে ও সঙ্গে অ্যাক্টিভিটি করছে (নাচ, গান, ছড়া) এবং অন্যান্য সময় পরিবারের সবার সঙ্গে কমিউনিকেশন করছে, এমন শিশুর ভাষা নিয়ে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা কম। অন্যদিকে যে শিশুটির পরিবারের সবাই ব্যস্ত, যাকে খাওয়ানোর সময়, ঘুমের আগে স্ক্রিন দেখানো হয় এবং বয়স উপযোগী কথা বলা হয় না তার ভাষা নিয়ে সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
ডিভাইস যখন শেখার মাধ্যম: সন্তান স্ক্রিনে কোন কিছু দেখছে এবং মা-বাবা যদি সে সময় সন্তানের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে স্ক্রিন দেখে ও অ্যাক্টিভিটি করে সেক্ষেত্রে সমস্যা না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। প্যারেন্ট যা করতে পারেন -
> স্ক্রিনে কি হচ্ছে তা শিশুকে বলা। শিশুকে প্রশ্ন করা।
> স্ক্রিনে দেখানো বিষয়টির বা কাজের নাম বলা, রং বলা, আকার বলা (বৈশিষ্ট্য)।
> বাস্তব কাজের সাথে স্ক্রিনের কাজের মিল করা। যেমন, "ব্রাশ ইউর টিথ" এই গানটি টিভিতে দেখানো ও পরে দাঁত মাজার সময় বলা।
> ডিভাইসে দেখানো অ্যাক্টিভিটি সন্তান বাবা-মা একসাথে করা। যেমন- ছড়ার সাথে গলা মেলানো ও হাতের ইশারা করা।
ডিভাইসের ব্যবহারে পরিবারের সচেতনতা :
১. প্রতিদিনের নির্দিষ্ট একটি সময়ে সব ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস দূরে সরিয়ে সন্তানের সঙ্গে সময় কাটান।
২. ঘরে যেখানে সন্তানের সঙ্গে কোয়ালিটি টাইম কাটাবেন এমন নির্দিষ্ট একটি জায়গা সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক ডিভাইস মুক্ত রাখুন।
৩. খাবারের সময় ইলেকট্রনিক ডিভাইস দূরে রাখুন। শিশুকে খাবারের রং, ঘ্রাণ ও স্বাদ বুঝতে দিন। শিশু কি খাচ্ছে তার নাম, রঙের নাম ও স্বাদের নাম শিশুকে জানান।
৪. ঘুমের কমপক্ষে এক ঘণ্টা আগে যাবতীয় ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহারে বিরত থাকুন।
৫. সন্তানের সামনে পরিবারের বড়রাও প্রয়োজন ছাড়া মোবাইল ব্যবহারে বিরত থাকুন।
স্ক্রিন টাইম শিশুকে তার পরিবারের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতে ও শিখতে বাধা দেয়। শিশুর মনোযোগ স্ক্রিনের দিকে থাকলে তার আশেপাশে কি হচ্ছে শিশু তা বুঝতে পারে না। যেহেতু সরাসরি যোগাযোগ বা কমিউনিকেশন শিশুর ভাষার বিকাশ ও সামাজিক বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তাই স্ক্রিন টাইমের ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক হতে হবে। দিনের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে ডিভাইস দেখলে খুব একটা সমস্যা হয় না এবং ডিভাইস আসক্তি তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।