ডলার আয়ে নজর পর্যটন খাতে

শুধু লম্বা ছুটি নয়, এখন টানা তিনদিন ছুটি পেলেও দেশের মানুষ বেড়িয়ে পরে সেই ছুটি উপভোগ করতে। আর দেশের মানুষের প্রথম পছন্দই কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত। এখনতো ট্রেনে করে কক্সবাজার নেমে সৈকতে যাবার আগেই ঝিনুক মিলছে ট্রেন স্টেশনেই। হ্যাঁ ঝিনুক সদৃশ ট্রেন স্টেশনটিই মনে হয় এক নতুন আকর্ষণ, যারা প্রথমবারের মত পৌঁছাবেন সৈকত শহরটিতে। না, ঠিক কক্সবাজারের র্দীঘ সৈকতের সৌন্দর্য বা ভ্রমণ কাহিনী নয় আজকের এই আয়োজন দেশের পর্যটন শিল্প নিয়ে। এদেশে জাতীয় পর্যটন নীতি হয়েছে তাও ১৫ বছর, বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড, আছে স্বাধীনতার পরপরই গড়ে ওঠা বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনও। কিন্তু যদি বলেন পর্যটন শিল্পের কথা, তাতে অনটন ঘোচেনি ৫৩ বছরেও।
এখন আমরা সবকিছুই বিচার করছি জুলাই-আগস্ট অভুত্থানের আগে পরের বিবেচনায়। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে একটি ফ্যাসিস্ট সরকারকে রুখে দিয়েছে ছাত্রদের নেতৃত্বে দেশের জনগণ। গত বছরের ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত অন্তবর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার পারদ তুঙ্গে উঠলেও এখন তা কিছুটা থিতিয়েছে। যদিও এক ডজন সংস্কার কমিশন হলেও বঞ্চিত হয়েছে অর্থনীতি, কৃষি এবং শিক্ষা খাত। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে শ্বেতপত্র তৈরিকে নিশ্চয় সংস্কার কমিশন হিসেবে চালানো যাবে না। মূল অর্থনীতি নয় আজ বলছি অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপুর্ণ খাত পর্যটন শিল্পের কথা। যদিও এটি সেবাখাত তবুও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এক বড় উৎস হিসেবেই তা বিবেচিত হয়। শ্রীলংকা, নেপাল বা ভুটানের মত দেশেতো ডলার আয়ের এ এক প্রধানতম খাত। এই অঞ্চলে আমরা পিছিয়ে আছি ভারত, পাকিস্তান ও মালদ্বীপ থেকেও।
আলোচনার অবতারণা এজন্য যে অর্ন্তবতী সরকারও কিছুটা মনযোগ দিতে শুরু করেছে পর্যটন খাত নিয়ে। আগস্টের নতুন সরকারে উপদেষ্টাদের মধ্যে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব পেয়েছিলেন ব্যারিস্টার হাসান আরিফ। তার মৃত্যুর পর অবশ্য এটি অনেকদিন ছিল প্রধান উপদেষ্টার হাতেই। সম্প্রতি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পেয়েছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা বশির উদ্দিন। একজন ব্যবসায়ী কতটা নজর দেবেন পর্যটনে, অপেক্ষায় থাকতে হবে। আর ঐ যে উল্লেখ করেছিলাম অন্তর্বতী সরকার নজর দিয়েছে তার উদাহরণ হলো এরই মধ্যে পর্যটন আইন ও জাতীয় পর্যটন নীতি সংশোধনের লক্ষ্যে স্টেকহোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় শুরু করেছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের হিসেবে সর্বশেষ ২০২৩ সালে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটক এসেছে ৬ লাখ ৫৫ হাজার। সরকারের পরিসংখ্যানের অবিশ্বস্ততা আমাদের এক বড় সমস্যা, বিশেষ করে অর্থনিতর জন্য। যেমন একজন সাবেক পর্যটন মন্ত্রী সংসদে জানিয়েছিলেন দেশের জিডিপিতে নাকি পর্যটন খাতে অবদান ৫%, যা কেউ মানতে চাইবে না। বেসরকারি ট্যুর অপারেটরদের সংগঠন টোয়াব এই দুটি তথ্যের সঙ্গে একবারেই একমত নয়। তারপরও নাকি বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড ও পর্যটন করপোরেশন ২০৪১ সালে ৫৫ লাখ টুরিস্টের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে বলে জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়েচে ভেলে কে জানিয়েছেন ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী।
এসব পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্কের চেয়েও এখন বেশি গুরুত্ব দেয়া দরকার, অর্ন্তবর্তী সরকার যে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা এবং পর্যটন আইন নিয়ে কাজ করছে সেটিতে। আগেই এ বিষয়ে সরকারের উদ্যোগে আলোচনার শুরুর কথা উল্লেখ করেছি। প্রস্তাবিত আইন ও নীতিমালার যে খসড়া পাওয়া গেলো তাতে যে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া গেলো না সেটা দিয়েই এই আলোচনার ইতি টানতে চাই। জাতীয় পর্যটন নীতিমালা-২৪ নিয়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছে তাতে আশাবাদী না হওয়ার কারণ হলো আগের পর্যটন নীতিমালা-১০ এর খুব বেশি ফারাক নাই। একই সঙ্গে নানা স্টেকহোল্ডারের মতামত নেয়া হচ্ছে পর্যটন আইনের খসড়া নিয়ে। পর্যটন করপোরেশন থাকার পরও বাংলাদেশের পর্যটন খাতকে এগিয়ে নিতে ২০১০ সালের জুনে জাতীয় পর্যটন নীতিমালা এবং জুলাই মাসে হয় বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড আইন। পর্যটন করপোরেশন ও টুরিজম বোর্ডের কার্যধারার পার্থক্য বুঝতেই চলে গেছে এক যুগ। এরই মধ্যে প্রায় ১৮ কোটি টাকার ওপরে খরচ করে তৈরি করা হয় ট্যুরিজম মাস্টারপ্লান। অবাক করার বিষয় নতুন পর্যটন নীতিমালাতেও আবারো মাস্টারপ্লানের কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন নাগরিকদের করের টাকায় তৈরি আগের মাস্টারপ্লানটির কি হবে?
প্রস্তাবিত নতুন নীতিমালায়ও আগের মতো সরকার প্রধানের নেতৃত্বে একটি জাতীয় পর্যটন পরিষদ, অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে পর্যটন সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি, পর্যটন মন্ত্রীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা কমিটি এবং সচিবের নেতৃত্বে আন্ত:মন্ত্রণালয় সমন্বয় কমিটি করার কথা বলা হয়েছে। অভিজ্ঞতা বলছে ২০১০ সালের পর আদৌ এসব কমিটি কতটা কার্যকর ছিল তা নিয়ে প্রশ্নের কোনো জবাব মিলবে না। আসলে দরকার পর্যটনের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১১টি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়। আর সরকার প্রধান বা পর্যটন মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব প্রাপ্ত মন্ত্রী পর্যটন নিয়ে কতটা সিরিয়াস তার ওপর নির্ভর করবে এই খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর কতটা উদ্যোগী হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না দেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন ও বিদেশি পর্যটকদের দেশে আনার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা বেসরকারি খাতের। বাংলাদেশ টুরিজম বোর্ড কতোটা স্বাধীনভাবে বেসরকারি খাতকে নানা বিষয়ে সহযোগিতা করবে সেটাই এক বড় প্রশ্ন। সম্প্রতি টুরিজম বোর্ড একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে এবং সেটা হলো বেসরকারি ট্যুর অপারেটরদের জন্য রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা করা। আবার বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে শুধু বিশ্বের নানা প্রান্তের পর্যটন মেলাগুলোতে অংশগ্রহণই শুধু নয় আমাদের সবগুলো দূতাবাসেই পর্যটন সেল করা খুবই জরুরি। এর সাথে আছে ট্যুরিস্টদের জন্য ভিসা সহজীকরণ, সাথে দরকার হবে দেশের ভিতরে একদিকে অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়ানো আর ট্যুরিস্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। বিণিয়োগ সম্মেলনে যোগ দিতে এসে যদি শ্রীলংকান বিনিয়োগকারীরাই অপহৃত হন তাহলে ট্যুরিস্টরা আসবে কেন? আর নানান দেশ যে প্রায় ট্রাভেল রেড এর্লাট জারি করে সে সম্পর্কে পর্যটন মন্ত্রনালয়ের সঙ্গে উদ্যোগী হতে হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও, যদি ডলারের আয় বাড়ানোর জন্য রপ্তানি আর প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ছাড়া আর কোনো বিকল্প ভাবি, প্রথমেই নজর দিতে হবে পর্যটন খাতের দিকে। অন্তর্বর্তী সরকার কি করবে কিছু?
মো আবু সাঈদ : ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক
Comments