অপরিণামদর্শী এবং অপরিকল্পিত অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক, একাডেমিক নয়
রোববার সন্ধ্যা থেকে সারারাত এবং সোমবার সারাদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও সাতটি কলেজের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর ঘোষণা এলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে সরকারি সাত কলেজ। নতুন করে ২০২৪-২৫ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে না। সোমবার সাত কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে ঢাবির উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমদ খানের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বিগত সরকারের আমলেও আমরা দেখেছি কোনো দাবি দাওয়া নিয়ে গেলেই সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হতো। এবার ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পরও এ অবস্থার পরিবর্তন হলো না। ব্যাপক সংঘর্ষ দেখে সংবেদনশীল নাগরিক মাত্রই ব্যথিত হয়েছে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এমন হলো? এই সাত কলেজের সঙ্গে দেশের প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা শুরু করে দেয়ার দায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের। বলতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঁধে এক বিশাল বোঝা চাপানো হয়েছিল অযৌক্তিক কারণে। একই সাথে এই সাত কলেজকেও একটা অনিশ্চয়তায় ফেলেছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই সিদ্ধান্ত।
২০১৭ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানী ঢাকার ঐতিহ্যবাহী সরকারি কলেজগুলোকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে সরকার। প্রথম দফায় রাজধানীর সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়। কলেজগুলো হলো-ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, মিরপুর সরকারি বাংলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ। বলা হয়েছিল 'এখন থেকে এসব কলেজে ভর্তি পরীক্ষা,পাঠ্যসূচি ও পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে'।
সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল, 'প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আজ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হলো সাতটি কলেজ'। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তখন ছিলেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তিনি বলেছিলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর আগ্রহ অনুযায়ী তার লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেব। এখন থেকে এই অধিভুক্ত কলেজগুলোর ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিচালিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস অনুযায়ী বিদ্যায়তনিক কার্যক্রমও পরিচালনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে'।
কিন্তু সেটা আর হয়নি। বরং আমরা দেখেছি অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে তখনকার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য অধ্যাপক হারুন অর রশিদের দ্বন্দ্ব সাত কলেজের পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। বলা হয় তাদের দু'জনের মধ্যকার রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে এই কলেজগুলোর ভর্তি পরীক্ষা, কলেজ পরিদর্শন, মূল্যায়নসহ কোনো কাজই ঠিকমতো হচ্ছিল না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এই সিদ্ধান্ত সহজভাবে নেননি। কিন্তু সরকার প্রধানের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করাও প্রকাশ্যে সম্ভব হচ্ছিল না। শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এমনকি সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনও এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছিল। ছাত্রলীগ এই সাত কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা করে দেয়ার দাবিও করেছিল কয়েক বছর আগে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব শিক্ষাগত এবং পরিবেশগত মানোন্নয়নে নজর না দিয়ে কলেজগুলোকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের অবনতি ঘটবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক থেকে অনাগ্রহ এতটাই ছিল যে, এই দীর্ঘ আট বছরে প্রশাসনিক ভবনে অধিভুক্ত কলেজগুলোর জন্য আলাদা কোন সেল বা ডেস্কও খোলা হয়নি। এমনকি প্রশাসনিক ভবনে একটি শাখাও ছিল না সাত কলেজের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের সেবা দেয়ার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আগ্রহ নেই, লোকবল নেই, সক্ষমতা নেই, কিন্তু সাতটি কলেজের লক্ষ লক্ষ পড়ুয়ার চাপ এসে পড়ল। ফলে সাত কলেজের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এসে আরও পিছিয়ে পড়ল। বরং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজগুলো এই সাত কলেজ থেকে এগিয়ে গেল সেশনে। কলেজগুলোর কোন কাজই ঠিকমতো এবং সময়মতো করতে পারেছিল না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর পর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এই সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা ভাবতে শুরু করেন তাদের সমস্যার সমাধান হয়তো হতে চলেছে। কিন্তু পাঁচ মাসেরও বেশি সময পরে এসে তাদের এখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াতে হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে। সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা তাঁদের কিছু সমস্যার সমাধানের দাবিতে কিছুদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বারবার যাচ্ছিলেন। এই দাবিগুলো হলো ২০২৪-২৫ সেশন থেকেই সাত কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি বাতিল করা, শ্রেণিকক্ষের ধারণ ক্ষমতার বাইরে শিক্ষার্থী ভর্তি না করা, শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষার্থী ভর্তি করা, ভর্তি পরীক্ষায় ভুল উত্তরের জন্য নম্বর কাটতে হবে ও সাত কলেজের ভর্তি ফির স্বচ্ছতা নিশ্চিতে মন্ত্রণালয় গঠিত বিশেষজ্ঞ কমিটির সঙ্গে সমন্বয় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত নতুন অ্যাকাউন্টে ভর্তি ফি জমা রাখতে হবে। দাবিগুলো যৌক্তিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আলোচনার ভিত্তিতে সমাধানের পথে হাঁটতে পারত। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সে পথে যায়নি বলেই ক্ষোভ তৈরি হয় সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে। সেখান থেকে এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা। ক্লাসে ক্লাসে মাত্রাতিরিক্ত পড়ুয়া, রুটিন আর পরীক্ষা নিয়ে লেজেগুবরে অবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে হেনস্থার শিকার হওয়া – সেটাই ছিল এদের নিয়তি। অপরিণামদর্শী এবং অপরিকল্পিত অধিভুক্তির সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক, একাডেমিক নয়। আর সে কারণেই পরিণতি হলো এমন বেদনাদায়ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এদের ছেড়ে দিল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কি দ্রুত এই সাত কলেজকে ঘরে ফিরিয়ে নিয়ে সমস্যার স্থায়ী সমাধান করবে নাকি সরকার এদের জন্য আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গঠন করবে? দেখার অপেক্ষায়।
লেখক: সাংবাদিক
Comments