পুলিশের কাজ, পুলিশের সংস্কার
পুলিশের কাজ নিয়ে আমাদের মাঝে নানা বিতর্ক আছে। শাসকের প্রশ্রয়ে, বিশেষ করে সেই শাসক যদি অতি স্বৈরতান্ত্রিক হয়, জনমতের তোয়াক্কা না করে বা আচরণে ফ্যাসিবাদী হয়, তাহলে পুলিশ জনগণের বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয়। এ দেশে যখন যে রাজনৈতিক দলই বিরোধী দল থেকেছে পুলিশের 'জুলুম আর নিপীড়ন' নিয়ে কথা বলেছে এবং ক্ষমতায় গিয়ে পুলিশকে আবার সেভাবেই ব্যবহার করেছে।
পুলিশের কাজই সমাজে শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখতে নজরদারি করা। যেহেতু আইন তৈরি ও রক্ষার দায়িত্ব শাসকের, ফলে শান্তি বজায় রাখতে পুলিশের কার্যকলাপ পরিচালিত হয় সরকারের নির্দেশে এবং সেটা অনেক সময়ই অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়। সরকারও প্রশাসনের নামে রাজনৈতিক সুবিধা তোলার জন্যে পুলিশকে ব্যবহার করে। পুলিশকে সরকার-বিরোধী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এবং দলের বিরুদ্ধে কাজ করতে বাধ্য করে। অথচ অতি সাধারণ মানুষই পুলিশের চাকরি নেয়। অন্য সব সরকারি চাকরির মতোই পুলিশও সরকারের চাকরিই করে। কিন্তু তাদের কাজটা এমনই যে নাগরিকের বাহবা পাওয়ার বদলে তাদের নামে জোটে বদনাম। কারণ অন্যসব সব সরকারি কর্মীর তুলনায় পুলিশের কাজ অতি দৃশ্যমান।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বিভিন্ন খাতের মতো একটি পুলিশ সংস্কার কমিশনও গঠিত হয়েছে এবং গত ১৫ জানুয়ারি কমিশন তার প্রতিবেদন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দিয়েছে। কমিশনের প্রতিবেদনের সার সংক্ষেপে বিভিন্ন বিষয় যেটুকু উঠে এসেছে তাতে বোঝা যায় কমিশন ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রভাব, প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অযাচিত হস্তক্ষেপ ও জবাবদিহিহীনতার মতো বিষয়গুলো প্রতিবেদনে রাখা হয়েছে। পুলিশে নিয়োগ,বদলি,পদোন্নতি ও চাকরিচ্যুতির ক্ষেত্রে পেশাদারত্ব নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে এবং 'প্রভাবমুক্ত' পুলিশ কমিশন গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথাও এসেছে।
পুলিশ সদস্যরা অনেক সময় নিজেরাই বেআইনি কাজ করেন, অপরাধ ও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এসব নিয়মিতই আমরা দেখেছি। আইনের লোক আইনি পথে চলে না বলেই মানুষের সাধারণ ধারণা। পুলিশ সদস্যরা এ সমাজেরই সমাজেরই সন্তান। আইন লঙ্ঘনের প্রবণতা একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হলে এই বাহিনীর উপরও তার প্রভাব পড়বে, এতে বিস্ময়ের কারণ নেই। কিন্তু উদ্বেগের কারণ নিশ্চয়ই আছে।
জুলাই আন্দোলনে পুলিশ মারমুখী ছিল, অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করেছে, নির্বিচারে গুলি করেছে এবং গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এসব নিয়ে খোদ পুলিশ বাহিনীর ভেতরেই এখন প্রশ্ন উঠছে যে এতটা সহিংস পুলিশ হলো কেন? সম্প্রতি পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, 'গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক কু-প্রভাবে পুলিশ যেসব ঘটনা ঘটিয়েছে, তা পৃথিবীর কোনো পুলিশ করেনি। এসব কর্মকাণ্ড পুলিশকে মারাত্মকভাবে হেয় করেছে। পুলিশ এতটা নির্মম হতে পারে তা চিন্তা করতেই লজ্জা হয়'।
একজন নাগরিকের কাছে বিপদের সময় সবচেয়ে বড় আশ্রয় পুলিশ। কিন্তু সেই পুলিশই যদি এমন আচরণ করে যে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয় তাহলে বলতেই হবে এই শৃঙ্খলা বাহিনীর কোন কোন সদস্য ঠিক পথে নেই। বিগত সরকারের রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে পুলিশের কর্মকাণ্ড বাহিনীর ভাবমূর্তির সংকট তৈরি করেছে। সহিংসভাবে আন্দোলন দমানো ছাড়াও নানা ধরনের নজির গড়েছে পুলিশ। বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীকে গুম করা, সাংবাদিক পেটানো, সাধারণ নাগরিককে হয়রানি করা, নারী ও শিশুকে নিগ্রহ করার বহু নজির রচিত হয়েছে।
বিগত সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীরা এগুলোকে বলতেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভাবতে পারা যায় না। পুলিশের উপর শাসকের নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাব কতখানি নিরঙ্কুশ হয়ে উঠেছিল সেই আলোচনা এখন নাগরিক সমাজে উঠছে। শৃঙ্খলা বাহিনীর যে কোন নেতিবাচক আচরণ গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক। তাই সরকারের উদ্যোগে এবার সংস্কারের পথে চলার চেষ্টা।
মানুষ পুলিশের কাছে দায়িত্বশীল আচরণ প্রত্যাশা করে,ক্ষমতার প্রদর্শন নয়। নানা সময় পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। অনেকগুলো সুপারিশও রাখা হয়েছিলো। ইউএনডিপি'র পুলিশ সংস্কার প্রকল্প থেকেও অনেক সুপারিশ এসেছিল। সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা জানা নেই। সময়ের পরিক্রমায় পুলিশের ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বাহিনীর প্রধানের মর্যাদা বেড়েছে, সুযোগ সুবিধা, পদোন্নতি সবই হয়েছে। কিন্তু মানুষের কাছে সেই উপনিবেশ আমল থেকে চলে আসা থানা যে এক আতংকের নাম, তা বদলায়নি।
ঔপনিবেশ আমলে পুলিশ বাহিনী গঠন হয়েছিলো মানুষকে মোকাবিলা করতে, জনগণের বন্ধু হওয়ার জন্য নয়। স্বাধীনতার পর থেকে কত কত কমিশন হলো, কমিটি হলো। কিন্তু কোনোভাবেই এ 'থানা সংস্কৃতি' থেকে আমরা আর বের হতে পারিনি। থানা নিয়ে মানুষের আতংক আছে। এই থানাই আবার মানুষের দোরগোড়ায় সাধারণকে রাষ্ট্রের পক্ষে ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রথম প্রতিষ্ঠান। কিন্তু মানুষ কেন তা মনে করে না? প্রথমত উন্নত বিশ্বে পুলিশ স্টেশন মানে সেবাকেন্দ্র। আমাদের দেশে তা রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রদর্শনের প্রধান কেন্দ্র। আর এভাবেই পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠেছে,জনগণ থেকে,সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন এক বাহিনী।
কিন্তু এভাবে একটি বাহিনী যুগের পর যুগ মানুষ থেকে দূরে থাকতে পারে না। মানুষের হয়ে উঠতে এই বাহিনীর একটি বড় অন্তরায় হলো রাজনৈতিকভাবে তাদের ব্যবহার। মানুষ পুলিশের কাছ থেকে চায় সেবা আর নিরাপত্তা। পুলিশের কাজ মানুষকে সেবা দেওয়া,তাদের সহযোগিতা করা,সাধারণ মানুষের নাগরিক মর্যাদা নিশ্চিত করা। মানবাধিকারের যে সাধারণ ধারণা আছে,পুলিশ ও জনগণের মধ্যে সহযোগিতা ছাড়া তা কখনোই অর্জিত হবে না।
জনবহুল দেশে,মানুষের নিরাপত্তা বিধানের কাজটি খুব সহজ নয়। বিশেষ করে সমাজে যখন অপরাধপ্রবণতা বেশি থাকে। কর্তৃত্বের সীমাবদ্ধতা তো আছেই,এ বাহিনীর অনেক সদস্যকেই কাজ করতে হয়,অন্য অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা নিয়ে। পুলিশ বাহিনীর দক্ষতা,আধুনিকায়ন আর ভাবমূর্তির উপর দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন নির্ভর করে। সমাজে পুলিশ কোনো ব্যক্তি বিশেষের কাছে দায়বদ্ধ থাকতে পারে না। তার দায়বদ্ধতা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই আগামী দিনের পুলিশকে জনগণের পুলিশ হিসেবে তৈরি করা সম্ভব হবে। পুলিশ যেন না হয়ে উঠে ক্ষমতাসীন মহলের আজ্ঞাবহ একটি বাহিনী।
লেখক: সাংবাদিক
Comments