প্রদেশ হলেই বিকেন্দ্রীকরণ হবে না
নতুন করে বাংলাদেশে ফেডারেল সিস্টেমের শাসন ব্যবস্থা আলোচনায় এসেছে। প্রশাসনিক সংস্কারের জন্য অন্তবর্তী সরকার গঠিত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন সদস্যরা জানিয়েছেন, তারা দেশের পুরোনো চারটি বিভাগকে চারটি প্রদেশ করার সুপারিশের কথা ভাবছেন।
এই চার প্রদেশ হলো ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও খুলনা। বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে চারটি প্রদেশ করার কথা ভাবা হচ্ছে। তবে এসব প্রদেশের পরিচালনা কাঠামো কেমন হবে, কাজ কী কী হবে, সেই ভাবনা এখনো পরিষ্কার নয়।
অনেকদিন আগে থেকেই এই প্রস্তাবনা রাজনৈতিক ময়দানে আছে। জাসদের তাত্বিক নেতা প্রয়াত সিরাজুল আলম খান বহু লেখায় এই প্রদেশ ভাবনার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন। তিনি ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামোর অধীন পূর্ব ও পশ্চিমে দুটি করে চারটি ও ঢাকাকে নিয়ে একটি মোট পাঁচটি প্রদেশ করার প্রস্তাব করেছিলেন। এরশাদ সরকারের বিরোধী দলে অবস্থানকালে জাসদ (রব) এই প্রস্তাব সমর্তন করেছিল।
এই প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি হলো রাজনৈতিক কাঠামোর ক্ষেত্রে উপমহাদেশের দেশসমূহ– বিশেষত ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের মিল বেশি। ভারতবর্ষের বর্তমান জনসংখ্যা দেড়শ কোটি এবং সেখানে মোট ২৯টি রাজ্য বা প্রদেশ রয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি চার কোটি মানুষের জন্য একটি রাজ্য। পাকিস্তানের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি এবং সেখানে প্রদেশের সংখ্যা পাঁচ। অর্থাৎ পাকিস্তানেও গড়পড়তা মোটামুটি চার কোটি মানুষের জন্য একটি প্রদেশ রয়েছে। তাদের কথা হলো আমাদের নিকটতম প্রতিবেশি দুটি দেশের যখন এ অবস্থা,তখন ১৮ কোটি জনসংখ্যা নিয়ে এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কেন আঁকড়ে ধরে আছি?
এটা ঠিক যে, ফেডারেল সরকার ব্যবস্থা থাকলে "ঢাকা কেন্দ্রিকতা" কমানো সম্ভব হতে পারে। ফেডারেল ব্যবস্থা সাধারণত বিভিন্ন অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসনকে উৎসাহিত করে এবং কেন্দ্রীয় সরকারকে কিছু দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখে, যা আঞ্চলিক সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এর ফলে, রাজধানী বা একটি নির্দিষ্ট শহরের উপর নির্ভরতা কমে যেতে পারে। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিবেচনায় নিলে এর উপকারের চাইতে ক্ষতিও বেশি হতে পারে।
প্রাদেশিক প্রথার কিছু উপকারিতা আছে যেমন ফেডারেল ব্যবস্থা আঞ্চলিক সরকারকে তাদের নিজস্ব আইন প্রণয়ন,বাজেট নির্ধারণ এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করার স্বাধীনতা দেয়। এর ফলে, প্রতিটি অঞ্চল তাদের নিজস্ব প্রয়োজন এবং সক্ষমতা অনুযায়ী উন্নয়ন করতে পারে। ঢাকার বাইরে অন্যান্য অঞ্চলে বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে, যা অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করবে। বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল, ভাষা এবং সংস্কৃতি রয়েছে। ফেডারেল ব্যবস্থা প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যকে রক্ষা এবং প্রচার করতে সহায়তা করতে পারে।
একটা বড় বিষয় যে ঠিকভাবে করতে পারলে প্রাদেশিক প্রথা কেন্দ্রীয় সরকারকে চাপমুক্ত রাখে অনেক দিক থেকে। কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর থেকে প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক চাপ কমে যাবে, যার ফলে তারা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে মনোযোগ দিতে পারবে।
তবে অনেকেই বলছেন এ দেশে 'প্রদেশ' সমস্যা সমাধানের বদলে বহু নতুন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। বিশিষ্ট স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বেক লেখায় লিখেছেন, "পাঁচটি প্রদেশে যদি ধরে নিই ৫০০ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হবেন। জাতীয় সংসদ সদস্যের মতো তাঁদের নানা সুযোগ-সুবিধা, গাড়ি, বাড়ি, সংসদ ভবন, প্রাদেশিক সচিবালয় ইত্যাদির প্রয়োজন পড়বে। ধরে নিলাম প্রতিটি প্রদেশে ১০ থেকে ১৫ জন প্রাদেশিক মন্ত্রী হবেন। তাঁদের জন্য প্রয়োজনীয় লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে। ৩৫০ জন জাতীয় সংসদ সদস্য ও ৩০ থেকে ৩৫ জন মন্ত্রীর ভারে জাতি ন্যুব্জ। আরও ৫০ থেকে ৬০ জন মন্ত্রী ও ৫০০ সংসদ সদস্যের বোঝা বহন করা এ জাতির জন্য দুরূহ ও দুর্বহ শুধু নয়, রাজনৈতিকভাবে অসহনীয় হয়ে উঠতে পারে"।
তিন এও বলেছেন, "যেহেতু নেপাল বা ভারতের মতো বাংলাদেশিরা বহুজাতিক,বহুভাষিক, প্রকটভাবে ধর্মীয় বিভাজনে বিভাজিত এবং ভৌগোলিকভাবেও বিচ্ছিন্ন ও বিভাজিত নয়,তাই এখানে শুধু জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে পাঁচটি প্রদেশ গঠন করা হলে অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক - এ তিনটি দিকে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করবে বলে আমার প্রাথমিক ধারণা"।
তাই প্রাদেশিক সিস্টেমের চ্যালেঞ্জগুলোও বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথম কথা হলো আমরা একটা আমলাতন্ত্রই চালাতে পারছি না। প্রদেশের মাধ্যমে তৈরি হওয়া চারটা আলাদা আমলাতন্ত্র জনগণের কাছে আরেক আতংক তৈরি করতে পারে। বিকেন্দ্রীকরণ যদি ভাবনাই হয় তাহলে প্রথমে সরকারের উচিত হবে জমি সংক্রান্ত মামলা-মোকদ্দমা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক কর্মকাণ্ডের বিকেন্দ্রীকরণ করা। এই লক্ষ্য নিয়ে এই বিকেন্দ্রীকৃত অফিস ও লোকবল স্থানীয় সরকার কাঠামোর ভিতরে যুক্ত করা। আগে স্থানীয় সরকার কাঠামোকে কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে মুক্ত করাই বড় বিক্রন্দ্রীকরণ হবে।
Comments