পরোক্ষ কর নির্ভরতা বৈষম্যমূলক
সম্প্রতি সরকার শতাধিক পণ্যে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক আরোপের পর মূল্যস্ফীতি নিয়ে আরেক দফা কথা হচ্ছে। অর্থ উপদেষ্টা এবং অন্তবর্তী সরকারের কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন এতে করে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে না। কিন্তু অর্থনীতি বিশ্লেষক নয় শুধু, সাধারণ মানুষও জানে অর্থ বছরের মাঝামাঝি এত বড় অভিঘাত তাদের সইতে হবে। সরকার নিজের যেহেতু টাকার খোঁজে আছে তাই সহজ পথে হেঁটেছে। প্রত্যক্ষ কর না বাড়িয়ে পরোক্ষ করোর মতো নিবর্তনমূলক ব্যবস্থায় এই টাকা সংগ্রহ করছে সরকার।
রাজস্ব আহরণে এই পরোক্ষ কর নির্ভরতা আমাদের পুরো কর ব্যবস্থাকেই বৈষম্যমূলক করে রেখেছে। বহু বছর ধরেই বলা হচ্ছে যে, দেশে জিডিপির অনুপাতে প্রত্যক্ষ কর আহরণের পরিমাণ অনেক কম, যেটি দেশে ক্রমবর্ধমান আয়বৈষম্যের অন্যতম বড় কারণ। তাই আয়বৈষম্য কমাতে ও কর–জিডিপির অনুপাত বাড়াতে হলে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে হবে। বাংলাদেশে কর–জিডিপির অনুপাত মাত্র ৮ বা ৯ শতাংশ। এটি সারা বিশ্বের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। এর বড় কারণ আমাদের প্রত্যক্ষ কর অনেক কম। দেশে যারা গরিব মানুষ,তারা আয়ের অনুপাতে সবচেয়ে বেশি ভ্যাট দেন। আর বেশি আয়ের মানুষ সবচেয়ে কম ভ্যাট দিচ্ছেন। এতে বৈষম্য বাড়ছে।
এই বৈষম্য কাঠামোগত। বাংলাদেশের সিংহভাগ রাজস্ব আয় আসে পরোক্ষ কর থেকে। বলা হয় রাজস্ব আয়ের প্রায় ৭২ শতাংশ আসে পরোক্ষ কর খাত থেকে। আর এই পরোক্ষ করের বড় অংশই ভ্যাট। ১৯৯১ সালে ভ্যাট আইনের মাধ্যমে এই কর প্রবর্তিত হয় এবং এটি পণ্য বা সেবা বিক্রয়ের বিভিন্ন স্তরে আরোপিত হয়। এই পরোক্ষ করের বড় অংশ যায় সাধারণ মানুষের পকেট থেকে। কারণ দরিদ্র মানুষের আয়ের সিংহভাগ যায় জীবনযাপনের ব্যয়ে, যেখানে ধনীদের আয়ের অনুপাতে তাদের ভোগব্যয় যৎসামান্য। বাকি টাকা তারা হয় সঞ্চয় করেন, নয়তো বিনিয়োগ করেন। পরোক্ষ কর চরিত্রে রিগ্রেসিভ,অর্থাৎ কার আয় কম বা বেশি,এই করের হার তার উপরে নির্ভর করে না। দেশের সেরা ধনী থেকে বস্তিতে বাস করা মানুষ প্রত্যেকেই সমান হারে পরোক্ষ কর দিতে বাধ্য।
যারা ধনী,তাদের থেকে বেশি হারে প্রত্যক্ষ কর আদায় করা যায়,কিন্তু এখানেই বর্তমান আমাদের রাজস্ব ব্যবস্থার কাঠামোগত সমস্যা। যাদের কর দেওয়ার ক্ষমতা আছে,তাদের অনেকে কর দেন না,আবার অনেকে কম কর দেন। এসব জায়গা থেকে প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে পারলে বৈষম্য কমবে। দেশের বেশির ভাগ মানুষ এখনও আয়কর-জালের বাইরে থেকে গিয়েছেন। প্রত্যক্ষ কর আদায়ের সেই তুলনামূলক ঘাটতি পরোক্ষ করের মাধ্যমে পূরণ করা হলে দরিদ্র মানুষের উপরে তার অভিঘাত স্বভাবতই বেশি হবে। করের আওতা বাড়ানোর এমন একটি পদ্ধতি আনতে হবে, যেটা দিয়ে আয় বাড়াবে।
আর্থিক অসাম্য অর্থব্যবস্থার পক্ষে খুবই কতখানি ক্ষতিকর। তীব্র অর্থনৈতিক অসাম্য গভীর বিপদ ডেকে আনতে পারে। তার একটি দিক হল,জীবনধারণের ন্যূনতম উপাদানগুলোও নাগরিকদের একটা বড় অংশের নাগালের বাইরে চলে যেতে পারে। তার মধ্যে যেমন অন্ন-বস্ত্র রয়েছে, তেমনই রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। ফলে এক প্রজন্মের আর্থিক অসাম্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিকাশ-সম্ভাবনাকে খর্ব করতে পারে। অন্য দিকে, সম্পদ যদি অতিধনীদের কুক্ষিগত হয়, তবে সার্বিক ভোগব্যয়ে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়া সম্ভব। তাতে আর্থিক বৃদ্ধির ক্ষতি। ফলে, বৈষম্য কমানোর কথা ভাবতেই হবে। সহজ পথে পরোক্ষ করে বসিয়ে গরিবদের পকেটে হাত না দিয়ে অতিধনীদের কাছ থেকেই টাকা বের করতে হবে সরকারকে।
লেখকঃ সাংবাদিক
Comments