খেলাপি সংস্কৃতির অবসান হোক
বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের এক বিশাল অংশের কাছে বড় ব্যবসা ব্যাংকের টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত না দিয়ে আত্মসাৎ করা। এই প্রক্রিয়ায় বিশাল এক ধনিক শ্রেণি তৈরি হয়েছে যাদের বড় একটা অংশ আবার দেশের বাইরে এই অর্থ পাচার করেছে। আশির দশক থেকে এই প্রবণতা ছিল এবং সরকারি ব্যাংকগুলো এই সংস্কৃতির বড় শিকার। তবে পলাতক স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে এর বিস্তার ঘটেছে প্রাইভেট ব্যাংকগুলোসহ নন-ব্যাংক আর্থিক খাতেও।
পি কে হালদার নামের একজন একাই সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকা মেরে দেশ থেকে চম্পট দিয়েছে। তবে সবাইকে পেছনে ফেলে খেলাপি ঋণ নামের ব্যাংক লুট ব্যবস্থার টেক্সট বুক দৃষ্টান্ত হয়ে গেছে চট্টগ্রাম ভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলম। তিনি রাষ্ট্রায়াত্ত্ব ব্যাংক থেকে টাকা তো নিয়েছেনই, নামে বেনামে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে বেসরকারি খাতের ব্যাংক থেকে যেগুলোর মালিকানায় ছিলেন তিনি নিজেই। চিরাচরিতভাবে বেক্সিমকো গ্রপের সালমান এফ রহমানের নামও আছে খেলাপিদের শীর্ষ তালিকায়। আরও অসংখ্য এমন বাণিজ্যিক গ্রুপ ও ব্যক্তি পাওয়া যাবে যারা হাজার হাজার এবং শত শত কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কোনো ব্যবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠা না করে টাকা আত্মসাৎ করেছে বা বিদেশে পাচার করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সম্প্রতি দেশের ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। তিন মাসেই ব্যাংক ব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। ব্যাংক থেকে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই বর্তমানে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বিগত সরকারের আমলে প্রভাব খাটিয়ে নেয়া ঋণগুলো খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে একাধিক ব্যাংক দখল করে একরকম অর্থ লুট করা হয়। নামে-বেনামে ঋণের নামে অর্থ বের করে নেয়া হয় শেখ হাসিনার সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রশ্রয়ে।
বর্তমান অন্তবর্তী সরকার তিন মাসে এই লুটপাট বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এস আলম কর্তৃক প্রায় নি:স্ব হয়ে যাওয়া ব্যাংকগুলোকে রক্ষা করতে পেরেছেন, নামে বেনামে ঋণ বন্ধ করতে পেরেছেন। চেষ্টা করছেন ব্যাংক ঋণ বিতরণে আন্তর্জাতিক মান মেনে চলতে। এরই আলোকে গতকাল বুধবার খেলাপি ঋণ বিষয়ে সর্বশেষ নীতিমালায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে কোনো ঋণ পরিশোধ না করলে তা মেয়াদোত্তীর্ণ হিসেবে গণ্য হবে। এরপর অনাদায়ি হিসেবে ওই ঋণ ৯০ দিন অতিক্রম করলে খেলাপি হয়ে যাবে। অর্থাৎ খেলাপি ঋণ বিষয়ে নিজেদের অবস্থান কঠোর করল বাংলাদেশ ব্যাংক।
এই কঠোরতা প্রত্যাশিত, যদিও প্রাথমিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে যেতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত ও খেলাপি ঋণের বিপরীতে অতিরিক্ত নিরাপত্তা সঞ্চিত রাখার কারণে ব্যাংকের মুনাফাতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কিন্তু উপকার যা হবে তা হলো এতে করে দেশের ব্যাংকগুলোর সম্পদের প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠবে।
আন্তর্জাতিক বেস্ট প্রাকটিসের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় এক যুগ পর নতুন নীতিমালা জারি করা হলো। বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণসংক্রান্ত নীতিমালা চূড়ান্ত করেছে। আশা করা যায় এতে করে ব্যাংক খাতে দুর্বত্তায়ন বন্ধ হবে। আমরা জানি বিগত সরকারের আমলে রাজনৈতিক প্রভাবে এই ঋণ নামের লুটপাট চালু ছিল। প্রকৃত শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা ব্যাংকের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঋণ না পেলেও দুর্বৃত্তরা ঠিকই পেত। নতুন কড়াকড়িতে প্রকৃত ব্যবসায়ী সমাজ উপকৃত হবে।
গত ১৫ বছরে অনাদায়ি ঋণের বোঝা লাঘবের সহজতম উপায়টি ছিল ব্যাংকের খাতা থেকে সেই অনাদায়ি ঋণটিকেই মুছে দেওয়া। অর্থাৎ মহামন্ত্র ছিল 'যা গেছে যাক'। এই মহামন্ত্রেই এই সময়টাতে ব্যাংকের খাতা থেকে মুছে গিয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ি ঋণ। ইচ্ছা করেই ঋণখেলাপি হয়েছেন যারা- অর্থাৎ, আর্থিক সামর্থ্য থাকার পরও ঋণ পরিশোধ করেননি, বা শোধ না করার উদ্দেশ্য নিয়েই ঋণ করেছেন,এক কথায় যারা ঋণের নামে জালিয়াতি করেছেন, তাদের পক্ষে সরকার ছিল, ছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। 'রাইট অফ' বা 'রি-শিডিউলিং' নামের ছলছাতুরি করে এদের মাফ করা হয়েছে।
এভাবে ব্যাংক যে টাকাটি মাফ করেছে তা যেমন হাওয়া থেকে আসেনি,তেমনই তা হাওয়ায় মিলিয়েও যেতে পারে না। হিসাবের কড়ি,কারও লাভ হলে কারও না কারও ক্ষতি হচ্ছেই। সেই ক্ষতি আমানতকারীদের,সৎ ঋণগ্রাহকদেরও। তারা আমানতের ওপরে কম সুদ পেয়েছেন,বা ঋণের ক্ষেত্রে তুলনায় বেশি সুদ দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে তার চেয়ে অনেক বড় ক্ষতি হয়েছে সমগ্র ব্যাংকিং ব্যবস্থার। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির পরও সেই ঋণ মওকুফ হতে পারে ক্ষমতা থাকলে,এই বার্তাটি ভয়ঙ্কর। এমন বার্তা শুধু এস আলম নয়, আরও অনেককে প্রলুব্ধ করেছে এই পথে হাঁটতে। যে অপরাধ মাফ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল,তা যে লোভনীয়,অস্বীকার করার উপায় নেই।
গত সরকারের আমলে ব্যাংকিং ব্যবস্থায় রাজনৈতিক ক্ষমতার হস্তক্ষেপের পরিসরটি বিশাল হয়ে উঠেছিল। ব্যাংকিং ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে থাকে সম্মিলিত বিশ্বাসের ভিতের ওপর। অবাধ ঋণখেলাপির সুযোগ সেই বিশ্বাসের একেবারে গোড়ায় আঘাত করে। ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপরে সাধারণ বিশ্বাসটি ধাক্কা খেলে তার কতখানি মূল্য দেশের অর্থব্যবস্থাকে চোকাতে হয় সেটা দেখছি আমরা যে অনেক ব্যাংক গ্রাহকের প্রয়োজনীয় টাকা দিতে পারছে না এখনও। আশা করি সব অনিয়ম কাটিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সামগ্রিক আর্থিক খাতে সেই বিশ্বাসটি ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে।
লেখক: সাংবাদিক