তত্ত্বাবধায়কের পক্ষে-বিপক্ষে আলোচনায় প্রাণবন্ত সংসদ

জুন ২৬, ২০১৩

400547475554d7dd950e9b21513e33a322800b5-300x200ঢাকা জার্নাল: সংসদের আলোচনায় ব্যাক্তিগত আক্রমণ বন্ধ না হলেও বুধবার শোনা যায়নি অশালীন বা অসংসদীয় কোন ভাষার প্রয়োগ। অবশ্য এদিন দু’দলের আলোচিত ওইসব নারীদের কেউই বক্তব্য রাখেননি। বাজেটের ওপর আলোচনা করেছেন দু’দলের জেষ্ঠ্য নেতারা। আলোচনার এক পর্যায়ে তারেক রহমানকে কটূক্তি করায় কিছু সময়ের জন্য অধিবেশন ওয়াক আউট করেন বিরোধী দলের সদস্যরা।

এদিকে অধিবেশন সমাপ্তির দিকে চলে আসায় অধিবেশন পরিচালনা করা হচ্ছে দু’বেলায়। আর তাই পালাক্রমে সভাপতির আসনে বসেন স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পীকার শওকত আলী।

বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা এদিনও সংসদে অসংসদীয় ভাষা ব্যবহারের কঠোর সমালোচনা করেন। জেষ্ঠ্য নেতাদের প্রত্যেকে তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকার নিয়ে নিজ নিজ দলের যুক্তি তুলে ধরেন। তাদের যুক্তি-খন্ডনে প্রানবন্ত হয়ে ওঠে অধিবেশন কক্ষ। এছাড়া মাঝে মাঝে জিয়াউর রহমানও তারেক জিয়াকে নিয়ে সরকারি দলের সদস্যদের টিপ্পনিতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে বিরোধী দলের মাঝে। আলোচনায় স্থান পায় হেফাজত ইস্যুও।

সরকারি দলের জেষ্ঠ্য সদস্য মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘ওয়ানস দালাল, অলওয়েজ দালাল- এই হলো জামায়াত।’

বিএনপির সিনিয়র সদস্য এম কে আনোয়ারের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, হেফাজতের তান্ডবের দিন যুবলীগের নেতা কোরআন শরীফে আগুন দিয়েছে- তার বক্তব্যে সম্পূর্ণ মিথ্যা। এভাবে মিথ্যার বেসাতি করে রাজনীতি হয় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও হিন্দু সম্প্রদায়কে উসকে দেওয়ার জন্য এ মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে।

হেফাজতের আমির আল্লামা শফীর উদ্দেশ্যে মতিয়া বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদেশে মদ, জুয়া বন্ধ করেছিলেন। পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে মদ, জুয়া চালু করে। তখন তো কোন কথা বলেন নি। এটা কেমন ইসলাম প্রিয়।’

আগামী নির্বাচন পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশন সময়মতো নির্বাচন করবে। এটা নিয়ে এত কথা বলার কোন দরকার নেই। বর্তমান নির্বাচিত সরকারই আগামী নির্বাচনের পর নির্বাচিত সরকারে হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি করে বলেন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের অস্তিত্ব সংবিধানে নেই। দেশের জনগণের মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এক ঐকমত গড়ে ওঠেছে। সদ্য সমাপ্ত চার সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে জনগণ রায় দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বরাবরই দাবি করে আসছেন, আপনি জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাসীন। জনগণের রায় মেনে না নিয়ে আপনি এখন বলছেন তত্ত্বাবধায়ক চাইলে নির্বাচনই হবে না। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে দেশবাসীর জন্য এক অশনি সঙ্কেত।

প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, নির্বাচন না করে আপনি কী করতে চান এটা দেশবাসীর কাছে পরিস্কার করা আপনার দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা সঙ্গতিপূর্ণ হবে এবং জনমনে কোন বিভ্রান্ত সৃষ্টি হবে না জাতি এটাই প্রত্যাশা করে।

তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী সংসদ ভেঙ্গে দেবেন অথচ নির্বাচন হবে না, তাহলে দেশ কিভাবে চলবে? তাহলে কী জনসমর্থন হারিয়ে প্রধানমন্ত্রী তৃতীয় শক্তিকে আমন্ত্রণ জানাতে চান। অথচ প্রধানমন্ত্রীই বার বার বলেছেন তৃতীয় শক্তি আসলে খালেদা জিয়া জেলের ভাত খাবে। মিথ্যা মামলা দিয়ে যে কাজটি আপনি করতে পারেননি, সেই কাজটি যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আসলেই হয়ে যাবে তা মানতে প্রধানমন্ত্রীর এত আপত্তি কেন ? তাই অপচিন্তা বাদ দিয়ে জনগণের রায় মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে দেশের মানুষের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনুন এবং দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা অব্যাহত রাখায় আপনার মূল্যবান অবদান রাখুন।

লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদ প্রস্তাবিত বাজেটের সমালোচনা করে বলেন, লাখ কোটি টাকার বাজেটের চেয়ে গরিব মানুষের স্বার্থের দিকে নজর দেওয়া উচিত ছিল। এটি করা হলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেত না। আগামী দিনে এজন্য ভয়ংকর পরিণতি অপেক্ষা করছে। লাখ-হাজার কোটি টাকার বাজেটে জনগণ যে সন্তুষ্ট নয়, তার প্রমাণ সাম্প্রতিক সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন।

তিনি বলেন, যে মন্ত্রী পুঁজিবাজার বোঝেন না কিংবা পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন, তার অর্থমন্ত্রীর পদে থাকা সমুচীন নয়।
ব্যাংকিং খাত, সাবমেরিন কেবলসহ অর্থনীতির বিকল্প খাতে সীমাহীন দুর্নীতি চলছে অভিযোগ করে অলি আহমেদ বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) নিয়ে জনগণের প্রত্যাশা থাকলেও সরকারের দলীয়করণ ও হস্তক্ষেপের কারণে তা পূরণ হয়নি। এক কথায় সব প্রতিষ্ঠানই সরকার দলীয়করন করে ফেলেছে।

আরও বলেন, এককেন্দ্রিক সরকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাই রাষ্ট্রীয় কাঠামো বিকেন্দ্রীকরন করা দরকার।

গত ৫ মে হেফাজত কর্মীদের ওপর পুলিশের হামলার অভিযোগ তুলে ধরে এলডিপি সভাপতি বলেন, এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়েছে Ñ রাতের অন্ধকারে দুই থেকে আড়াই হাজার মানুষকে হত্যা করা হতে পারে।

বিরোধী দলের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিরোধী দল ৫ মে হেফাজতের কর্মসূচিতে আড়াই হাজার লোক মারা গেছে বলে দাবি করে। যদি একটা মানুষের নাম বলতে পারেন তাহলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো।

আরও বলেন, আগামী নির্বাচন সাংবিধানিকভাবেই হবে। অসংবিধানিক কোন শক্তিকে ক্ষমতায় বসতে দেওয়া হবে না।

সেলিম বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রদান হবেন শেখ হাসিনা। যদি তার অধীনে নির্বাচন হয় তাহলে কোন ধরনের কারচুপি হবে না। আপনারও এতে অংশিদার হন।

বাজেট আলোচনায় রাশেদ খান মেনন বলেন, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে। নির্বাচনের সময় জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে দেয়ারও প্রস্তাব করেন তিনি।

বিরোধী দলের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা তৈরী করে তারা বাজেট বাস্তবায়নের অগ্রগতি ঠেকাতে চাইছে। বিএনপি-জামায়াত-হেফাজত এই তিন শক্তি মিলে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী ঐক্য তৈরী করেছে।

তিনি বলেন, অসাম্প্রদায়িক শক্তির অগ্রযাত্রা ধরে রাখতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিকল্প নেই।

প্রধানমন্ত্রী প্যারোলোর শর্ত ভঙ্গ করেছেন অভিযোগ করে বিএনপির এএনএম মাহবুব উদ্দীন খোকন বলেন, ১/১১ সময় দুই জন রাজনীতিবিদ প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্যে বিদেশ গিয়েছিলেন। একজন তারেক রহমান এবং অন্যজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারেক রহমান বলেছিলেন চিকিৎসাধীন থাকাকালীন সময়ে রাজনীতি করবেন না। তিনি কোন শর্ত ভঙ্গ করেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার শর্ত ভঙ্গ করেছিলেন।

সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সরকারে বিরুদ্ধে ডাক দিলেই লক্ষ লক্ষ মানুষ হয়। এটা দেখে সরকার ভয় পেয়েছে।

হেফাজতের কর্মসূচিতে সরকার নিরহ মানুষকে হত্যা করেছে অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, যারা হেফাজতের কর্মীদের হত্যা করেছে তাদের বিচার হবে।

সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দুর্নীতির অভিযোগ এনে খোকন বলেন, প্রধানমন্ত্রীর হাতে পরে আজ দুদকের দাঁত নেই। তারা দুদকের দুই পাটি দাঁতই ভেঙ্গে দিয়েছে। এক পাটি ভেঙ্গেছে যাতে সরকার দলের লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা না করতে পারে সেজন্যে। আর অন্য পাটি দাঁত ভেঙ্গেছে, বিরোধী দল ও বিরোধী দলীয় নেত্রীর পরিবারের লোজনের নামে মামলার করার জন্যে। দুদক মামলা করতে চায়নি বলে তার অপর পাটি দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। কিন্তু একদিন দুদকের নতুন দাঁত উঠবে।

সরকার দলীয় আসাদুজ্জামান নূর একজন বিদেশী সাংবাদিকদের বইয়ের উদ্ধৃতি করে বলেন, তারেক রহমানের সঙ্গে মাফিয়া ডন দাউদ ইব্রাহিমের সংশ্লিষ্টতা ও তারেক রহমানের আয়ের উৎস সঙ্গত নয়। তার এই বক্তব্যে প্রতিবাদ জানিয়ে অধিবেশন থেকে প্রতিকী ওয়াক আউট করেন বিরোধী দলের সদস্যরা। আবার পরক্ষনেই তারা ফিরে আসেন।

এদিন অনান্যের আলোচনায় অংশ নেন রেল মন্ত্রী মুজিবুল হক, আসাদুজ্জামান নূর, শেখ আব্দুল ওহাব, মাহমুদুস সামাদ চৌধুরী, মকবুল আহমেদ, সোলায়মান হক জোয়ার্দার সেলুন, ইকবালুর রহিম, সুকুমার রঞ্জন ঘোষ, আহাদ আলী সরকার, কবিরুল হক প্রমুখ।

ঢাকা জার্নাল, জুন ২৬, ২০১৩।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.