ঈদুল আজহার উৎসব ও পরিবেশ

চা রপাশে এখন বেশ উৎসবের আবহ। সবখানে আনন্দ। দু'টি ঈদই বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সর্বব্যাপী উৎসবময়তা এনে দেয়। তবে অন্য সব উৎসবের চেয়ে ঈদুল আজহার আনন্দ একদম আলাদা। এই উৎসব বিশেষভাবে মর্যাদা পায় ত্যাগের আনন্দে।
ইসলামের ইতিহাস বলে, আল্লাহ তাআলা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-কে তাঁর প্রিয় বস্তু কোরবানি করার নির্দেশ দেন। এরপর হজরত ইব্রাহিম তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে কোরবানি দেওয়ার জন্য নিয়ে যান। এর মাধ্যমে তিনি আল্লাহর প্রতি সর্বোচ্চ আনুগত্য প্রদর্শন করেন। এ সময় আল্লাহর নির্দেশে তিনি পুত্র ইসমাইলের বদলে সেখানে একটি দুম্বা কোরবানি দেন। এই মাস হজের মাস। যাঁরা হজ পালন করছেন, শুধু তাঁরাই নন, এ ঘটনার অনুসরণে সারা বিশ্বের প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমান কোরবানি দিয়ে থাকেন।
আমরা জানি সবাই কোরবানি দিতে পারেন না। সবার সামর্থ্য থাকে না। ধনী মুসলমানদের জন্য পশু কোরবানি করে এর নির্দিষ্ট অংশ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করার বিধান আছে। এটা দরিদ্র মানুষের হক আর তাই এই ন্যায্যতার দিকে সবারই খেয়াল রাখা উচিত।
উৎসব সব সময়েই উৎসাহবর্ধক। দৈনন্দিনতার ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে আলো-গান-হাসি-হুল্লোড়ের মধ্যে একটা বাড়তি জীবনীশক্তি পাওয়া যায়। কোরবানির ঈদ উৎসবের একটা বড় বিষয় পশুর বর্জ্য অপসারণ। শহারাঞ্চলে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভা এ কাজটি করে থাকেন। তবে নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্বও কম নয়। এবারের ঈদে কোরবানির পাশাপাশি ডেঙ্গু আতঙ্ক জনমনে উদ্বেগ হয়ে দেখা দিয়েছে। এ কারণেই কোরবানির পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বাড়তি গুরুত্ব ও সচেতন উদ্যোগের দাবি রাখে।
শুধুমাত্র সরকার ও প্রশাসনের পক্ষে কোরবানির পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পুরোটা করা সম্ভব নয়। কোরবানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর সর্বোচ্চ উদ্যোগের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের ঐক্যবদ্ধ উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই।
তাই এই উদযাপনের সাথে পরিবেশের ভাবনাটাও মাথায় রাখতে হবে। আমাদের মনোজগতে কিছু সমস্যা চিরস্থায়ী হয়ে আছে। আমরা মনে করি আনন্দটুকু করে নিলেই জীবন সার্থক, তার আগের বা পরের কিছু নিয়ে আমাদের আর মাথাব্যথা নেই। বৃহত্তর সমাজজীবনের সঙ্গে উৎসব এবং তার আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলিকে যোগ করা, এবং সমাধান করার কোন ইচ্ছে নেই।
এবারের ঈদ এসেছে বিশ্ব পরিবেশ দিবসের মাত্র তিন দিনের মাথায়। আমাদের ভাবনায় এই পরিবেশ বিষয়টা থাকুক। আমরা পরিবেশ সম্মত কোরবানি করতে পারছি না। বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলোতে এখন আর প্রকাশ্যে পশু কোরবানি হয় না। নির্দিষ্ট জায়গায় কোরবানি হয় এবং সেখান থেকে মাংস বন্টন করা হয়। প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক এই চেষ্টা করেছিলেন, তবে নাগরিক সাড়া পাননি। আমরা সেটা পারিনি, কিন্তু আমরা তো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ভালো করতে পারি।
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর বর্জ্য পরিবেশসম্মতভাবে ব্যবস্থাপনার জন্য দেশের সব নাগরিকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। এ সময় যত্রতত্র পশু জবাই, উচ্ছিষ্ট ফেলা ও বর্জ্য জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি তৈরি করে বলে জানিয়েছে মন্ত্রণালয়। প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, কোরবানির সময় গবাদিপশুর রক্ত, গোবর, নাড়িভুঁড়ি ও অন্যান্য পরিত্যক্ত অংশ যত্রতত্র ফেলে রাখার কারণে পরিবেশ দূষণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও জনদুর্ভোগ দেখা দেয়। এ অবস্থায় সবাইকে সচেতনভাবে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এখন দেখার পালা আমরা সরকারের এই অনুরোধ কতটা রক্ষা করতে পারছি। আমরা যেন মনে রাখি পাড়া, মহল্লা, বাসাবাড়ির কোণে কোণে পড়ে থাকা আবর্জনাস্তুপ অসুখের আঁতুড়ঘর হয়ে উঠতে পারে।
প্রতিবারই কোরবানি শেষে এ দিক সে দিক ছড়িয়ে থাকা বর্জ্য ও নানা ময়লা-আবর্জনা আমাদের নাগরিক জীবনকে কষ্টদায়ক করে রাখে। দেশে 'পরিবর্তন'-এর সরকার এসেছে। এখন দেখার পালা আমাদের নাগরিকদের মাঝে সেই পরিবর্তনটা এসেছে কিনা, তার ব্যাপ্তি বাড়ছে কিনা। আমরা অপেক্ষায় থাকবো আদপেও কোন পরিবেশ সচেতনতার বার্তা পৌঁছল কিনা আমাদের মনোজগতে ও আচরণে।
Comments