তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবে খালেদা জিয়ার অবদান: ইতিহাসে উপেক্ষার রাজনীতি?
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির যাত্রা শুরু হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার হাত ধরেই। কিন্তু এ সত্যটি আজকের তরুণ প্রজন্মের কাছে অনেকটাই অজানা। বর্তমান তরুণ প্রজন্মের অধিকাংশই বেগম খালেদা জিয়ার সময়কার প্রযুক্তি খাতের অগ্রগতি দেখেনি। আর কেউ তাদের তা জানানোর চেষ্টাও করেনি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের 'উন্নয়নের মহাসড়ক' প্রচারণার গর্জনে সেই ইতিহাস যেন হারিয়ে গেছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের প্রকৃত সূচনা হয়েছিল খালেদা জিয়ার হাত ধরেই। এটাই ধ্রুবসত্য।
১৯৯৩ সালেই বুলেটিন বোর্ড সিস্টেম বা বিবিএস পদ্ধতির মাধ্যমে ডায়াল-আপ সংযোগ ব্যবহার করে ইমেইল ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি ছিল বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি ইতিহাসের এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এরপর দেশে অফলাইন ইন্টারনেট চালু হয়, যার মাধ্যমে সীমিত পরিসরে ইমেইল আদান-প্রদান ও তথ্য অ্যাক্সেসের সুযোগ তৈরি হয়। এই উদ্যোগগুলোর সবই গৃহীত হয়েছিল বিএনপি সরকারের সময়।
মুলত ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সময়টিকে তাই বলা যায়—বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তির "বীজ বপনের যুগ"। এই সময়ে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্ত ছিল দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। স্যাটেলাইট টেলিভিশন চালুর ফলে মানুষ তথ্যপ্রবাহে সংযুক্ত হয়, টেলিযোগাযোগ খাতে উদারনীতির ফলে মোবাইল ফোন সেবা দেশে প্রবেশ করে, এবং ইন্টারনেট যুগের সূচনা হয়। দুটি যুগান্তকারী ঘটনাই ঘটে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত বিএনপি সরকারের আমলে। প্রথমে অফলাইন ইন্টারনেট এবং ৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অনলাইন ইন্টারনেট চালু হয়, যা ছিল বিএনপি সরকারের উদ্যোগের ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ চালু হয়। ফলে আইসিটির শুভসূচনা ঘটে দেশে।
বেগম খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১–২০০৬) তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিকাশ পায় নতুন মাত্রা। সরকার তখন উপলব্ধি করে—দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিক্ষা ও প্রশাসনকে আধুনিকিকরণের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি অপরিহার্য। ফলে গঠন করা হয় নতুন একটি মন্ত্রণালয়—বিজ্ঞান ও তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন ড. আব্দুল মঈন খান এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রথমবারের মতো আলাদা নীতিনির্ধারণী মর্যাদা পায়।
২০০২ সালে প্রণীত হয় জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা, যা দেশের প্রথম আইসিটি পলিসি। যা ডিজিটাল অবকাঠামো, আইটি শিক্ষা ও ই-গভর্ন্যান্স উন্নয়নের ভিত্তি স্থাপন করে। এতে বলা হয়—তথ্যপ্রযুক্তি হবে একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের হাতিয়ার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম চালিকা শক্তি। একই বছর প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), যা টেলিকম খাতে নীতিমালা নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এটি ছিল দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের ইতিহাসে একটি যুগান্তকারী ঘটনা।
২০০৩ সালের ডিসেম্বরে মাইক্রোসফট করপোরেশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান ও সেই সময়ের শীর্ষ ধনী বিল গেটস প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে আসেন। সরকারের সাথে, বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মাইক্রোসফট-সংক্রান্ত বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথেও তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। এরপর বেগম খালেদা জিয়ার সরকার ধারাবাহিকভাবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি উন্নয়নকল্পে বিভিন্ন উদ্যোগ হাতে নেয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা, প্রসার ঘটে এর মধ্যে।
এই সময়েই প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কালিয়াকৈরে হাই-টেক পার্ক স্থাপনের প্রকল্প গ্রহণ করেন। তালিয়াবাদ আর্থ স্যাটেলাইট স্টেশনের কাছে কালিয়াকৈরে ২৩১.৬৮৫ একর জমি বরাদ্দ দিয়ে দেশের প্রথম হাই-টেক পার্কটি নির্মাণ করা হয়। ২০০৪ সালের ২৪ এপ্রিল বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয়ের কাছে জমি হস্তান্তর করেছিল ভূমি মন্ত্রণালয়। একই সময়ে সরকার সরকারি দপ্তরগুলোতে কম্পিউটার ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে, প্রশাসনিক কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু করে এবং তরুণ প্রজন্মকে আইটি শিক্ষায় উৎসাহিত করে।
খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত আইসিটি টাস্কফোর্স ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী সংস্থা, যেখানে মন্ত্রী, বিশেষজ্ঞ, উদ্যোক্তা ও তরুণ নেতাদের সমন্বয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হতো। ২০০১ থেকে ২০০৬ সময়কালে দেশের বিভিন্ন স্কুল ও কলেজে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং সফটওয়্যার শিল্পে প্রণোদনা প্রদানের কাজ শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুদান দেওয়া হয়, যাতে তারা তথ্যপ্রযুক্তি-ভিত্তিক গবেষণায় যুক্ত হতে পারে।
এই সময় তরুণ রাজনীতিক তারেক রহমান তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে নতুন প্রজন্মের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত করেন। তিনি দেশের বিভিন্ন স্থানে তরুণদের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেন। এরই ধারাবাহিকতায় তখন পাবনা জেলার তথ্য ও স্থিরচিত্রগুলো তুলে ধরার জন্য তরুণ মেধাবী খালেদ হোসেন পরাগকে 'মাই পাবনা' শিরোনামের একটি প্রজেক্ট দেন তারেক রহমান। খালেদ হোসেন পরাগও বেশ ভালোভাবে উদ্যমী হয়ে কাজটি সম্পূর্ণ করলেন। এই ভাবে তিনিও তরুণ সমাজকে উদ্ভাবনী কাজে সম্পৃক্ত করার আহ্বান জানান এবং স্থানীয় পর্যায়ে বিজ্ঞানমুখী চিন্তাধারার প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
২০০৩ সালে জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড সামিট অন ইনফরমেশন সোসাইটিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে অংশ নেওয়া এই প্রতিনিধি দল সেখানে ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণ, প্রযুক্তিতে বৈশ্বিক সহযোগিতা এবং জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের ওপর জোর দেন। এ সময় বেগম খালেদা জিয়া স্বল্পোন্নত দেশগুলোর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ব্যবহার এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির খরচ মেটাতে প্রস্তাবিত ডিজিটাল সংহতি তহবিল গঠনের জন্য জোর সুপারিশ জানিয়েছিলেন। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রযুক্তি কূটনীতির প্রথম সাফল্য।
২০০৩ সালেই চালু হয় সাধারণ জনগণের জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব ইন্টারনেট ডোমেইন—ডটবিডি (.bd)। এটি বাংলাদেশের অনলাইন পরিচয়ের প্রতীক, যা দেশের প্রতিষ্ঠান, সংবাদমাধ্যম ও সংগঠনগুলোকে বৈশ্বিক পরিসরে নিজস্ব পরিচিতি দেয়।
২০০৪ সালে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি শিক্ষায় দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা দিতে মাধ্যমিক স্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত 'শহীদ জিয়াউর রহমান আইসিটি বৃত্তি' চালু করা হয়। তারও আগে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আইসিটি শিক্ষায় দরিদ্র মেধাবী মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বৃত্তি প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। প্রথমবার 'শহীদ জিয়াউর রহমান আইসিটি স্কলারশিপ' প্রদান অনুষ্ঠানে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, পলিটেকনিক এবং স্নাতক পর্যায়ের ৪৪ জন শিক্ষার্থীকে চেক ও সনদ দিয়েছিলেন।
২০০৬ সাল ছিল বাংলাদেশের প্রযুক্তি ইতিহাসে আরেকটি স্মরণীয় বছর। সেই বছরের ২১ মে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সংযুক্ত হয় বৈশ্বিক সাবমেরিন কেবল সিস্টেম SEA-ME-WE-4-এর সঙ্গে। এটি দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের জন্য ছিল এক নতুন যুগের সূচনা। একই বছরে প্রণয়ন করা হয় 'তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬', যা দেশের ডিজিটাল কার্যক্রমের আইনি কাঠামো তৈরি করে। এটি ছিল ই-গভর্ন্যান্স, ই-কমার্স, ই-সিগনেচারসহ ডিজিটাল কার্যক্রমের জন্য একটি পথপ্রদর্শক আইন।
এর আগে খালেদা জিয়া চট্টগ্রামে উদ্বোধন করেন দেশের প্রথম আধুনিক ডিজিটাল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, যা ৮৩ হাজারেরও বেশি গ্রাহককে সংযুক্ত করার সক্ষমতা রাখত। সেসময় তিনি বলেছিলেন, 'অবকাঠামো নির্মাণই শেষ কথা নয়, বরং এগুলোর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করলেই দেশবাসীর অগ্রগতি ও কল্যাণ সাধন সম্ভব'।
বিএনপি সরকারের এই সময়েই বাংলাদেশ সফটওয়্যার রপ্তানি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। বিশ্বব্যাংক ও জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের সফটওয়্যার শিল্প দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান খাত হিসেবে উঠে আসছে।
তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশে সরকার সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বকে উৎসাহিত করে। ফলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, হার্ডওয়্যার ইম্পোর্ট, প্রশিক্ষণ এবং আইটি সেবার ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যায় এগিয়ে আসে।
এমনকি গ্রামের মানুষও প্রযুক্তির ছোঁয়া পেতে শুরু করে। 'আমাদের গ্রাম' নামের প্রকল্পটি খুলনা অঞ্চলে তৃণমূল পর্যায়ে আইসিটি প্রশিক্ষণ চালু করে, যা পরিচালিত হয়েছিল বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সহায়তায়। এই প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ জনগণের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি ও জীবিকা উন্নয়ন।
তথ্যপ্রযুক্তির এই সাফল্য কোনো একক ব্যক্তি বা দলের নয়—বরং এটি ছিল একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফল, যার নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং তার দলের নীতিনির্ধারকরা। খালেদা জিয়া তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে এই ধরনের বহুমুখী ও যুগোপযোগী বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেগম খালেদা জিয়ার সরকারই ছিল এই খাতের প্রকৃত অগ্রদূত। তাঁর সরকারের সময়েই তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সরকারগুলো সেই ভিত্তির উপরই কাজ করেছে, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই সে কাজ হয়েছে দুর্বল ও অদক্ষভাবে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, আজ সেই ইতিহাস অনলাইনে অনুপস্থিত। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে বিভিন্ন সরকারি ওয়েবসাইট ও অনলাইন উৎস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে এসব তথ্য। অথচ ইতিহাস বিকৃত করলেই বাস্তব পরিবর্তন হয় না—সত্য নিজেই নিজের আলোয় জ্বলে ওঠে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের সূচনা হয়েছিল বেগম খালেদা জিয়ার সময়েই—যে সময়ের গল্প এখন প্রায় হারিয়ে গেছে ডিজিটাল শব্দের আড়ালে। সময় এসেছে সেই সত্যকে পুনরুদ্ধার করার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার। অনলাইন আর্কাইভ, ডিজিটাল মিউজিয়াম এবং সরকারি তথ্যবিবরণী মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক তথ্যগুলো সংরক্ষণ ও হালনাগাদ করা সময়ের দাবি।
রাজীব হাসান: লন্ডন প্রবাসী গণমাধ্যমকর্মী ও তথ্যপ্রযুক্তিবিদ।
Comments