সড়কে গণহত্যা
বাংলাদেশের সড়ক আজ কেবল যাতায়াতের পথ নয়, এ যেন অনবরত মৃত্যুর মিছিল। পাঁচ বছরে নিহত ৩৩ হাজারের বেশি মানুষ, আহত অগণিত। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, দেশে ২১টি এলাকা এখন 'অতি উচ্চ ঝুঁকি'। এই এলাকাগুলো হলো - ঢাকা, ধামরাই, গাজীপুর, কালিহাতী, শিবচর, ভাঙ্গা, ঈশ্বরদী, মিরসরাই, চকরিয়া, ভালুকা, ত্রিশাল—সবই এক একটি মৃত্যুর চৌরাস্তা। এই স্থানগুলোতেই কেবল ৪,৬০০ এরও বেশি মানুষের প্রাণ গেছে।
প্রশ্ন হলো, এই মৃত্যুগুলো কি কেবল দুর্ঘটনা? না কি এ এক ধারাবাহিক গণহত্যা, যেখানে রাষ্ট্র, প্রশাসন ও সমাজের নীরবতা যেন এক নীরব অনুমোদন?
দুর্ঘটনা মানে আকস্মিকতা। কিন্তু যখন প্রতিদিন একই জায়গায়,একই ধরনের ব্যর্থতায়,একই অবহেলায় মানুষ মরতে থাকে - তখন তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। তাকে বলা যায় একটি পরিকল্পিত সামাজিক হত্যাযজ্ঞ,যেখানে কারও হাতে অস্ত্র নেই,কিন্তু সবাই দায়ী।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে এখন গতি মানেই মৃত্যু। সড়ক প্রশস্ত,গাড়ি দ্রুত,কিন্তু চালক প্রশিক্ষণহীন,সিগন্যাল অকার্যকর,পুলিশ তদারকিহীন। যাত্রী ওঠা-নামার নির্দিষ্ট জায়গা নেই, মোটরসাইকেল ছুটছে বিপরীত লেনে, ট্রাক ঘুরছে এলোমেলোভাবে - এই বিশৃঙ্খলা যেন এক প্রাতিষ্ঠানিক নৈরাজ্য।
যখন রাষ্ট্র আইন বানায় কিন্তু প্রয়োগ করে না,যখন লাইসেন্স টাকা দিয়ে হয়,যখন সড়কের পাশে দোকান বসে,হাট বসে,তখন সেসব স্থানে প্রতিদিনই মৃত্যু "স্বাভাবিক" হয়ে ওঠে। এই স্বাভাবিকতা-ই ভয়ংকর।
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের অর্ধেকের বেশি তরুণ। মানে দেশের ভবিষ্যৎ। তাদের রক্তে আমরা উন্নয়নের রাস্তা রাঙাচ্ছি -একটি রাষ্ট্র যখন জানে,তার সড়কে প্রতিদিন গড়ে ১৮–২০ জন মানুষ মারা যায়,তবুও চোখ বন্ধ রাখে,তখন সেটি নিছক প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়;সেটি এক নৈতিক হত্যাযজ্ঞ।
২০১৮ সালে সড়ক নিরাপত্তা আইন হয়েছিল ছাত্র আন্দোলনের পর। সেই আন্দোলনে কিশোরেরা স্লোগান দিয়েছিল, "আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো,সড়ক চাই নিরাপদ হোক।" সাত বছর পর সেই স্লোগান আজও সমাধি হয়ে পড়ে আছে শহরের ধুলোয়। আইন বইয়ে আছে,বাস্তবে নেই। চালকরা আগের মতোই লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালায়,ফিটনেসবিহীন বাস রাস্তায় নামে,হাইওয়ে পুলিশের ভূমিকা প্রায়ই প্রতীকী।
চট্টগ্রামের মিরসরাই,ফরিদপুরের ভাঙ্গা,মাদারীপুরের শিবচর - এই এলাকাগুলোর নাম সংবাদে আসে কেবল দুর্ঘটনার পর। দুই দিন কান্না,তিন দিন শোক,তারপর সব ভুলে যাওয়া। কিন্তু যারা প্রিয়জন হারায়,তাদের জীবনে সেই শোক স্থায়ী। এক মা প্রতিদিন রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবেন,তার ছেলে কি ফিরে আসবে? এক স্ত্রী সন্তানকে বলে,"বাবা দূরে গেছে"—কিন্তু জানে,ফিরে আসবে না।
প্রশ্ন আবারও সেই - এই মৃত্যুগুলোকে আমরা কেন দুর্ঘটনা বলে স্বস্তি পাই? কারণ "গণহত্যা" বললে দায় তৈরি হয়। রাষ্ট্রকে জবাব দিতে হয়। কিন্তু রাষ্ট্র তার নিজের নাগরিকের মৃত্যুর দায় নিতে চায় না। তাই পরিসংখ্যানকে "অ্যাকসিডেন্ট রিপোর্ট" বলে দাফন করা হয়।
আমরা যে সমাজে বাস করি,সেখানে মৃত্যু এখন সংবাদ,জীবন নয়। রাজনৈতিক বক্তৃতায় মেট্রোরেল,এক্সপ্রেসওয়ে,ফ্লাইওভার - সব আছে;কিন্তু নেই একটিও জাতীয় কৌশল সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার।
যে দেশে প্রতিদিন রাস্তায় মানুষ মরছে,সেখানে সড়ক নিরাপত্তা এখন আর কেবল ট্রাফিক ব্যবস্থার বিষয় নয় - এটি মানবাধিকারের প্রশ্ন।
আন্তর্জাতিক সংজ্ঞা অনুযায়ী,কোনো রাষ্ট্র যদি নাগরিকের প্রাণহানি প্রতিরোধে সক্ষম হয়েও ব্যবস্থা না নেয়,তবে তা state negligence leading to mass killing - রাষ্ট্রীয় অবহেলায় গণহত্যা। বাংলাদেশ এখন সেই সংজ্ঞার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে।
অবশ্য দায় কেবল সরকারের নয়। সমাজেরও এক ভয়াবহ নৈতিক পতন ঘটেছে। আমরা রাস্তা পার হতে গিয়ে দেখি দুর্ঘটনা - তবুও দেখি না। আহত পড়ে থাকে,কেউ ভিডিও তোলে,সাহায্য করে না। এই উদাসীনতাই সড়কে মৃত্যুকে দৈনন্দিনে রূপ দিয়েছে।
এখনও সময় আছে।
রাষ্ট্র চাইলে,পুলিশ চাইলে,প্রশাসন চাইলে সড়ক নিরাপদ করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোও একসময় এমন রক্তক্ষয় দেখেছে,কিন্তু তারা আইনের প্রয়োগ,চালক প্রশিক্ষণ,জনসচেতনতা,কঠোর নজরদারি - সব মিলিয়ে সড়ককে জীবনের পথে ফিরিয়ে এনেছে। বাংলাদেশও পারে,যদি চায়।
কিন্তু চাইবে কি?
নাকি আমরা আরও কিছু বছর পর শুনব -"গত পাঁচ বছরে নিহত হয়েছে আরও পঞ্চাশ হাজার"? তখন হয়তো কেউ বলবে,"দুর্ঘটনা তো ঘটেই।" না,এটি দুর্ঘটনা নয়। এটি এক গণহত্যা - যেখানে রক্ত আমাদেরই,কিন্তু দায় কেউ নেয় না।
লেখক : সাংবাদিক
Comments