এই আগুনের শেষ কোথায়?

দেশজুড়ে হঠাৎ করে আগুন লাগতে শুরু করেছে। গার্মেন্টস কারখানা, বিমানবন্দর, সরকারি দফতর, রাসায়নিক গুদামঘর ও শপিং কমপ্লেক্সসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় একের পর এক আগুনের ঘটনায় জনমনে দেখা দিয়েছে আতঙ্ক।
আমাদের স্বাভাবিক ধর্ম হলো ষড়যন্ত্র তত্ত্ব চর্চা করা এবং এখনও তাই হচ্ছে। এসব অগ্নিকাণ্ডের ঠিক তদন্ত হবে কি হবে না তার নিশ্চয়তা না থাকলেও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের চর্চা শুরু হয়েছে। বলা শুরু হয়েছে - এসব কি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি এর পেছনে আছে পরিকল্পিত নাশকতা? দুর্ঘটনা বা নাশকতা – যেটাই হোক তদন্ত প্রয়োজন, দোষীদের শাস্তি প্রয়োজন এবং বেশি প্রয়োজন আগুনের পুনরাবৃত্তি রোধে ব্যবস্থা নেওয়া।
অতীতে আমরা লাগাতার আগুন লাগার ঘটনা দেখেছি। প্রতিবারই এই নাশকতার কথা বলে শেষ পর্যন্ত আগুন লাগার প্রকৃত ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়। বারবার কিছু ঘটতে থাকলে তা চূড়ান্ত অস্বাভাবিক ঘটনাকেও ক্রমে স্বাভাবিক করে তোলে। বিধ্বংসী আগুনে বাংলাদেশের কোনও না কোনও অঞ্চলের মানুষ সর্বস্ব হারাবেন; নিজের বা প্রিয়জনের জীবন যাবে, আজীবনের স্বপ্ন পুড়ে গিয়ে কোনও নারী, বৃদ্ধ শূন্যদৃষ্টিতে চেয়ে থাকবেন; পুড়ে যাওয়া স্থাপনার অনতিদূরে কোনও শ্রমিকের পুড়ে যাওয়া হাত পড়ে রইবে, সংবাদপত্রে পাতায় তা ভালো ছবি হবে, কোনও শ্রমিকের মা বা স্ত্রী বা সন্তান কারখানার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়বেন - এই দৃশ্যগুলো বহু বছর ধরেই এমনই স্বাভাবিক যে সেগুলো সংবাদমাধ্যমের চিত্রগ্রাহকের ক্ষণিক মনোযোগের চাইতে বেশি কিছু আর দাবি করে না।
আগুনের শিখা নির্বাপিত হলে দগ্ধাবশেষের পার্শ্বেই পড়ে থাকে কেবল একটি সত্য - এই আগুনই শেষ নয়। এই শহরে, অন্য শহরে ভবিষ্যতে আরও অনেক আগুন, আরও অনেক ক্ষয়ক্ষতি লুকিয়ে আছে। আগুন সত্য, কারণ অগ্নিবিধিকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করবার প্রবণতা আমাদের মাঝে। নাশকতার বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তদন্ত করে নিশ্চিতভাবে বলতে পারবে। তবে দেশে আগুন কেন্দ্রিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক অসতর্কতা সর্বত্র বিদ্যমান।
বাংলাদেশে আগুন লাগা এক স্বাভাবিক ঘটনা। তবু কিছু কিছু আগুনের ঘটনা নতুন করে ভাবায় আমাদের। কোনও কোনও ঘটনা আমাদের সামনে বড় বাস্তবতা উপস্থিত করে। রাজধানীতে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো সেকশনের আগুন তেমনি এক ঘটনা। শনিবারের এই আগুন টাকার অঙ্কে ক্ষতি করেছে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু দেশের প্রধান বিমানবন্দরে যখন এমন আগুন লাগে, নেভাতে সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে তখন দেশের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা সহজেই অনুমেয়।
মনে পড়ে ২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের শীতলপুরের আগুনের কথা। সেখানকার বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের নয় জন কর্মীসহ চল্লিশের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। কোনও ঘটনায় এত অগ্নিনির্বাপণ কর্মীর মৃত্যু এটিই প্রথম। আহত দুই শতাধিক, যাদের অনেকে চিরতরে পঙ্গু হয়ে যাবেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এই কিছুদিন আগে, টঙ্গীতে রাসায়নিক গুদামে লাগা আগুন নেভাতে গিয়ে দুজন ফায়ার ফাইটারের মৃত্যু হয়। পুরোনো ঢাকায় একের পর এক রাসায়নিক গুদামের আগুন যে কত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে তার পরিসংখ্যানও নেই।
প্রশ্ন আসছে - দায় নেবে কে? সত্য হলো কেউ নিবে না। আজ পর্যন্ত কোনও ঘটনায় সংশ্লিষ্টদের বড় কোনও শাস্তি হয়নি। দায়িত্বশীল কেউ পদত্যাগও করেননি।
নাশকতা নাশকতা করে ঘটনাকে হালকা করার প্রবণতা আছে আমাদের। নিশ্চয়ই এগুলো শুধুই দুর্ঘটনা নয়। এগুলো হলো রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নিয়ম নীতি প্রয়োগের অভাব ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। কখনও আমরা দেখি না রাষ্ট্র উদ্যোগী হচ্ছে এই অনাচারের সমাপ্তি টানতে। একটা ঘটনা ঘটে, রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা কিছু কথাবার্তা বলেন, কত কত প্রতিশ্রুতি দেন। বলা হয় এটা করা হবে, ওটা করা হবে। তারপর পরবর্তী বিপর্যয়ের জন্য চলতে থাকে অপেক্ষা।
অগ্নিকান্ডের সাথে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। বিধির ফাঁক গলে একের পর এক আগুনের ঘটনা ঘটে। উচ্চমানের অগ্নি-নিরাপত্তা যেমন চাই, তেমনি চাই মানুষের জন্য অনেক বেশি প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা। এ দেশের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক মান থেকে যোজন যোজন দূরে। আন্তর্জাতিক মানের বিধি তৈরি হলেও যতক্ষণ প্রশাসন তা প্রয়োগ করতে আন্তরিকভাবে চেষ্টা না করবে, ততক্ষণ সব বিধিই অসার। মানুষের চাওয়া সামান্যই - আর কোনো প্রাণ যেন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার আগুনে দগ্ধ না হয়, আর কোন সম্পদ যেন ছাই হয় না যায়।
লেখক : সাংবাদিক
Comments