ঢাকা: এক উজ্জ্বল নগরীর নিঃসঙ্গ হৃদয়

ঢাকা,বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র, এক ঝলমলে অথচ বিভ্রান্ত নগরী। এখানে সকাল মানেই কোলাহল, রাত মানেই আলো-ঝলমল পরিশ্রমের দীর্ঘশ্বাস। রিকশার ঘণ্টি, বাসের হর্ণ, ধুলায় মোড়া আকাশছোঁয়া অট্টালিকা - সব মিলে এই শহর এক নিরবচ্ছিন্ন গতির প্রতীক। কিন্তু এই উদ্দাম ছন্দের ভেতরেই লুকিয়ে আছে এক নীরব ব্যাধি -বিচ্ছিন্নতা।
শহরটি যত দ্রুত বেড়ে উঠছে, তার মানুষ ততটাই একা হয়ে পড়ছে। উন্নয়ন,আধুনিকতা আর বাজারের তাড়না মানুষকে একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। ঢাকা আজ ব্যস্ত, কিন্তু মানসিকভাবে শূন্য -এক এমন শহর, যেখানে ভিড় আছে, কিন্তু মানুষে মানুষে সম্পর্ক নেই।
ঢাকা আজ বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল শহরগুলোর একটি। প্রায় আড়াই কোটি মানুষের এই নগরীতে প্রতিদিন ঢুকে পড়ে আরও হাজারো অভিবাসী - কাজ, শিক্ষা বা কেবল টিকে থাকার আশায়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই অভিবাসনকে আরও তীব্র করেছে; নদীভাঙন, বন্যা, লবণাক্ততা মানুষকে ঠেলে দিচ্ছে রাজধানীর দিকে।
কিন্তু এসবের জন্য ঢাকাকে কখনও প্রস্তুত করা হয়নি। রাস্তাগুলো জ্যামে পঙ্গু, বাসস্থান নাগালের বাইরে, আর খোলা জায়গা বাণিজ্যিক দখলে হারিয়ে গেছে। ফলে এ শহর ঘন জনবসতিপূর্ণ, কিন্তু শূন্য হৃদয়। বহুতল ভবন আর বস্তি পাশাপাশি দাঁড়ালেও তাদের বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো সংযোগ নেই। শরীরের ভিড়ের ভেতর সম্পর্কের নিঃসঙ্গতা ক্রমে গভীর হচ্ছে।
ঢাকায় দিন মানে অপেক্ষা, যানজট,প্রতিযোগিতা, আর বেঁচে থাকার লড়াই। সময় হারিয়ে যায় যাতায়াতে; ক্লান্তি গ্রাস করে সহানুভূতি। এখানে মানুষ কাজ করে বাঁচতে, কিন্তু বাঁচে না কাজের আনন্দে।
কার্ল মার্ক্সের 'শ্রম বিচ্ছিন্নতা' তত্ত্ব যেন ঢাকার প্রতিটি অফিস আর কারখানায় মূর্ত হয়ে আছে। এখানে কর্মজীবীরা যন্ত্রের মতো উৎপাদন করে, কিন্তু সেই শ্রমের সঙ্গে আত্মিক ও মানসিক সম্পর্ক নেই। কাজ হয়ে যায় শুধুই টিকে থাকার উপায়, নয় আত্মার মুক্তি।
সমাজবিজ্ঞানী দুর্খেইম যে 'অ্যানোমি'র কথা বলেছিলেন - দ্রুত পরিবর্তনের ফলে মূল্যবোধের ভাঙন - ঢাকায় তা আজ স্পষ্ট। যৌথ পরিবার হারিয়েছে, প্রতিবেশী সম্পর্ক নিঃশেষ হয়েছে, সবাই ব্যস্ত নিজের বৃত্তে।
জর্জ সিমেলের 'মেট্রোপলিটন ব্লাসে' তত্ত্বও যেন ঢাকায় প্রতিদিন জীবন্ত। নগরজীবনের অতিরিক্ত উদ্দীপনা - শব্দ, ভিড়, ধোঁয়া - থেকে বাঁচতে মানুষ গড়ে তোলে এক শীতল মুখোশ। অপরিচিত মুখের ভিড়ে সবাই হয়ে পড়ে উদাস, যেন সহানুভূতি এক অপ্রয়োজনীয় বিলাস।
এই শহর শ্রেণিতে বিভক্ত — প্রাচীরঘেরা ধনীদের ঢাকা, ক্লান্ত মধ্যবিত্তের ঢাকা, আর বেঁচে থাকার সংগ্রামে নিমজ্জিত দরিদ্রদের ঢাকা। গুলশান বারিধারা, ডিওএইচএসের বিলাসিতা আর কামরাঙ্গীরচরের বস্তির মধ্যে পার্থক্য শুধু অর্থের নয়, মনুষ্যত্বেরও।
শহরের ভৌগোলিক বিভাজন এক নতুন সামাজিক বাস্তবতা তৈরি করেছে- যেখানে প্রতিবেশী মানে অচেনা,আর একতা মানে ইতিহাস। নগরের মানচিত্রই যেন অসমতার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একসময় ঢাকার প্রাণ ছিল পাড়ার চায়ের দোকান, খেলার মাঠ, বা রাস্তার মোড়ের আড্ডা। আজ সেই জায়গাগুলো দখল করেছে কফিশপ, শপিংমল, আর ছাদবাগান রেস্টুরেন্ট। দেখা মানে এখন খরচ করা, বন্ধুত্ব মানে বিল।
শহরে খোলা জায়গা কমে গেছে, কমিউনিটি সেন্টার অবহেলিত, পার্কে জায়গা নেই। সামাজিক মেলামেশা হয়ে পড়েছে ক্ষণস্থায়ী ও পৃষ্ঠতলীয়। সম্পর্ক গড়ে ওঠে ঠিকই, কিন্তু গভীরতা হারায়।
প্রযুক্তি মানুষকে সংযুক্ত করেছে, কিন্তু ঘনিষ্ঠ করেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজার বন্ধুর মাঝেও মানুষ একা। লাইক আর ইমোজি আসল কথার বিকল্প হয়ে গেছে।
ঢাকায় এখন বিষণ্ণতা, উদ্বেগ ও মানসিক ক্লান্তি নতুন মহামারি। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এক জরিপ বলছে, প্রতি পাঁচজন নাগরিকের একজন ক্লিনিক্যাল স্ট্রেসে ভুগছেন -একাকিত্ব এর মূল কারণ। এমন মানসিক বিচ্ছিন্নতা সামাজিক বন্ধনকেও ক্ষয়ে দিচ্ছে। নাগরিক আস্থা কমে যাচ্ছে,পাড়া-প্রতিবেশী হারাচ্ছে সম্পর্কের উষ্ণতা,সম্মিলিত উদ্যোগ ভেঙে পড়ছে। শহর হারাচ্ছে তার সামাজিক স্থিতি,তার আত্মা।
সংস্কৃতিতেও সেই প্রতিফলন। দুই একটি স্পট ছাড়া ভালো সিনেমা হল নেই, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নেই। সৈয়দ শামসুল হকের 'তিন পয়সার জোছনা' বইতে যে সাহিত্য আর সংস্কৃতি প্রেমী ঢাকার ছবি পাই সেই ঢাকাও নেই।
ঢাকাকে সুস্থ করতে হলে নতুন চোখে দেখতে হবে। উন্নয়ন মানে কেবল রাস্তা বা টাওয়ার নয়, মানুষে মানুষে সংযোগও এক ধরনের অবকাঠামো। হাঁটাচলার উপযোগী রাস্তা, কমিউনিটি পার্ক,লাইব্রেরি, সাংস্কৃতিক কেন্দ্র - এগুলোই শহরের আসল প্রাণ।
সরকারি নীতিতে কমিউনিটি অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। যুব সংগঠন,পাড়া কমিটি,স্বেচ্ছাসেবী দল - এইসব উদ্যোগ ফিরিয়ে আনতে পারে সামাজিক আস্থা। মানসিক স্বাস্থ্যকেও নগর স্বাস্থ্যনীতির মূলধারায় আনতে হবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিল্প-সংস্কৃতির মাধ্যমেই নাগরিক সংহতি গড়ে তোলা সম্ভব। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, থিয়েটার, গণমাধ্যম -সবাইকে যুক্ত হতে হবে এক মানবিক ঢাকার নির্মাণে।
ঢাকার সংকট মূলত মানবিকতার সংকট। যদি শহর কেবল মুনাফা, ছুটে চলা আর প্রতিযোগিতার মাপকাঠিতে এগোয়, তবে একদিন হয়তো তা প্রযুক্তিতে উন্নত হবে, কিন্তু মানবিকতায় দেউলিয়া হয়ে যাবে।
তবুও আশার জায়গা আছে। পৃথিবীর অনেক শহর - সিউল, কুরিতিবা, কোপেনহেগেন - দেখিয়েছে, সঠিক পরিকল্পনা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে শহরকে মানবিক করা যায়। ঢাকাও পারবে, যদি সে চায় মানুষকে ফিরিয়ে আনতে তার কেন্দ্রবিন্দুতে।
ঢাকার বিচ্ছিন্নতার গল্প আসলে আধুনিকতার গল্প — যেখানে অগ্রগতি মানে কংক্রিট, কিন্তু নয় করুণাময়তা।
এই শহরের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এক প্রশ্নে
ঢাকা কি শুধু উঁচু দালানের শহর হয়ে থাকবে?
না কি আবার হবে এক মানবিক সমাজের আবাস?
যেখানে ভিড়ের মাঝেও মানুষ একে অপরকে খুঁজে পাবে?
লেখক: সাংবাদিক
Comments