পথ পৌঁছে দিক জীবনে, সড়কগুলো যেন মৃত্যু-পথ হয়ে না দাঁড়ায়

লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার পশ্চিম চৌপল্লী গ্রামের কাচারিবাড়ি এলাকার ওমান প্রবাসী বাহার মা সন্তান ও স্ত্রীসহ ৭ জন স্বজনকে হারিয়ে এখন অনেকটাই পাগল প্রায়। তার এই ট্রমা আজীবন থাকবে। ওমান ফেরত প্রবাসী বাহারকে নিয়ে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলায় তাদের বহনকারী মাইক্রোবাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খালে পড়ে এই সাতজন নিহত হন। বুধবার ভোরে লক্ষ্মীপুর-নোয়াখালী মহাসড়কের বেগমগঞ্জ উপজেলার আলাইয়াপুর ইউনিয়নের পূর্ব জগদীশপুর এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
যে বাহার স্বজনদের টানে ফিরে এসেছিলেন, এখন তাদের সমাহিত করতে হলো তাকেই। দুই বছরের কন্যা মীমকে দেখেছেন প্রথমবারের মতো মঙ্গলবার রাতে বিমান বন্দরে। কোলে নিয়েছেন মাত্র একবার। তারপর সব শেষ।
এরকম অসংখ্য পরিবার প্রতিদিনই ট্রমায় পড়ছে, অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে, অসংখ্য মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করছে। আমাদের সড়ক মহাসড়ক সবই যেন মরণফাঁদ। পথ মানুষকে পৌঁছে দেয় জীবনে। কিন্তু আমাদের সড়ক পথ নিয়ে যায় মৃত্যুর দিকে। বছর শেষ হয়, দুর্ঘটনার হিসেব হয়, আমরা জানতে পারি বিদায়ী বছরটি কতটা প্রাণঘাতী ছিল এবং আবার ভুল যাই। সব আগের মতো চলতে থাকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশন বলছে, মে মাসের তুলনায় জুন মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সাড়ে ২২ শতাংশের বেশি বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২৩ জন মারা গেছে। সংগঠনটি জানায়, সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৪৬৩ কোটি ২০ লাখ টাকার মানব সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।
কিন্তু রাজনীতি, অর্থনীতি বা জনপরিসরের কোন আলোচনায় সড়কে ঘটে যাওয়া গণহত্যার বিষয়ে কোন আলোচনা সেভাবে নেই। সবাই মনে হয় ধরেই নিয়েছে এভাবেই প্রাণ যাবে মানুষের,কিছু করার নেই। এমনকি কোন যানবাহন ব্যবহার না করা পথচারীরাও মারা যাচ্ছে দুর্ঘটনায়। এ দেশে পথে নামা মানেই যেন প্রাণ হাতে বেরোনো।
বলা হচ্ছে, ওমান প্রবাসী ও তার পরিবারকে বহন করা গাড়ির চালক ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। চালকের অদক্ষতা, অসতর্কতা ও খাম খেয়ালি, ঘুমিয়ে যাওয়া অবশ্যই অনেক কারণের একটি। কিন্তু সড়কের চরিত্র, রক্ষণাবেক্ষণ, সেখানে চলাচল করা যানবাহনের বিন্যাস, তাদের গতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর নজরদারি ও প্রয়োজন মতো দণ্ডবিধান – কোন কিছুই ঠিক নেই বাংলাদেশে।
সড়ক দুর্ঘটনা আর পরিবহন নৈরাজ্য একসাথে চলছে বাংলাদেশে। এক মূর্তিমান বিপদ সড়ক দুর্ঘটনা, বলেকয়ে যা আসে না। কত পরিবারকে পথে বসিয়ে দেয় একটা দুর্ঘটনা তার হিসাব নেই। দিন দিন পথ দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে, কিন্তু কোনো জায়গা থেকেই এর রাশ টেনে ধরার উদ্যোগ নেই। এখানেও বৈষম্য দৃশ্যমান। কারণ, এসব দুর্ঘটনায় অতি সাধারণ পথচারী ও যাত্রী এবং দরিদ্র পরিবহন শ্রমিকদের বেশি মৃত্যু ঘটে বিধায় তা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই কোথাও।
জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়কে বাস-ট্রাকের মতো ভারী ও দ্রুতগতির যানের সঙ্গে মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, ব্যাটারি রিকশা বিভিন্ন নামের হালকা ও ধীরগতির যানও গণপরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুর্ঘটনায় প্রাণহানি বেড়েছে। গণ পরিবহনে যে নৈরাজ্য তার সাথে আছে রাজনীতি, ক্ষমতার প্রভাব। ক্ষমতা কাঠামোকে ব্যবহার করে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্যবদ্ধ হয়ে পুরো সিস্টেমকেই নিজেদের করায়ত্ব করেছে একটি চক্র। এ কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের যেসব একেবারে মৌলিক পদ্ধতি, সেগুলোই প্রয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না।
২০১৮ সালের ছাত্র-ছাত্রীদের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের পর বিগত সরকার একটি আইন করেছিল ঠিকই, কিন্তু সেটি ছিল এক নখদন্তহীন আইন। আবার শাহজান খানদের দাপটে সেই আইনটিও বাস্তবায়িত হয়নি কোনদিন। পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিক নেতাদের এক ভয়ংকর ঐক্য জাতীয় সংসদে পাস হওয়া একটি আইনকে আটকে রেখেছিল শুধু নিজেদের স্বার্থ ঠিক রাখার জন্য। সড়ক নৈরাজ্যের সেরা দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন বাংলাদেশের গণপরিবহন খাতের নেতা শাহজান খান গংরা।
সরকার বদলেছে, কিন্তু সড়ক নৈরাজ্য চলছেই। কারণ কোন আইন বা নীতি বাস্তবায়ন করতে গেলেই পরিবহন ধর্মঘট করে যাত্রীদের জিম্মি করার কৌশল নেয় পরিবহন মাফিয়া গোষ্ঠী। বাংলাদেশে আর কোনো খাত নেই যেখানে নৈরাজ্যের পক্ষে মালিক শ্রমিকের এমন একটা ভয়ংকর ঐক্য দেখতে পাওয়া যায়। সড়ক আইন রুখতে আমরা দেখেছি পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙছে, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ও চালক উভয়ের মুখে পোড়া মোবিল লাগিয়ে দিচ্ছে। মোটরসাইকেল, সিএনজি, রিকশা এমনকি ভ্যানও চলাচল করতে তারা বাধা দিয়েছে। সে সময় এগুলো তারা করেছে পুলিশের নাগের ডগায়, বিনা বাধায়। এতেই বোঝা যায় রাজনৈতিকভাবে কতটা প্রশ্রয় উপভোগ করত পরিবহন খাতের মাফিয়ারা।
এক মাফিয়া গোষ্ঠী গেছে। দেখতে হবে নতুন কোন গোষ্ঠী যেন নৈরাজ্য কায়েম করতে না পারে। দেশে গাড়ির সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে এবং বাড়তেই থাকবে। তাই দুর্ঘটনা কমানোর জন্য বেশি জোর দিতে হবে ব্যবস্থাপনায়। প্রথমেই নজর দিতে হবে সড়ক ব্যবস্থাপনার দিকে। উন্নয়ন ও মেরামতের জন্য আমাদের সড়কগুলো যানবাহনের স্বাভাবিক চলাচলের জন্য প্রস্তুত থাকে না। দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বাস ও ট্রাকচালকদের বেপরোয়া আচরণ বড় ভূমিকা রাখছে। তারা সাধারণত ট্রাফিক আইনের তোয়াক্কা করে না, মানুষের জীবনের ব্যাপারেও তাদের ভেতর সংবেদনশীলতা কম।
কী কী কারণে এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে, কী কী পদক্ষেপ করলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব – এ সব বহু-আলোচিত। অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো ও ঝুঁকিপূর্ণ যান চালানোর কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটে। চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণেও দুর্ঘটনা ঘটে। গাড়ি চালানো সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার ও ড্রাইভারের অসতর্কতার কারণে দুর্ঘটনা এখন প্রায় নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ নমুনা ওমান প্রবাসীর জীবনে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা।
ট্রাফিক আইনে শাস্তির বিধান থাকলেও আইনরক্ষকদের ঢিলেঢালা ভাব ও দুর্নীতির কারণে গাড়িচালকদের মধ্যে আইন ভাঙার প্রবণতা আছে। বাস, ট্রাক চালকদের একটা বড় অংশ আবার মদ্যপান করে গাড়ি চালান। অতীতে দুর্ঘটনার জন্য দায়ী চালকদের বিচার ও শাস্তি সেভাবে নিশ্চিত করা হয়নি।
অবৈধ ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক এবং ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির মালিক, চালক ও শ্রমিকরাই পরিবহন খাতকে নৈরাজ্যের মধ্যে রেখেছে। এদের সহায়ক দীর্ঘদিন ধরে এ খাতে রাজত্ব করা কিছু পরিবহন শ্রমিক নেতা ও মালিক। এরা আইন করতে দেয় না, আইনের বাস্তবায়ন চায় না, এমনকি আধুনিক পরিবহন ব্যবস্থা প্রণয়নের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে।
পরিবর্তিত সময়ে এসে আমরা চাই এসব মৃত্যু যেন রাষ্ট্রের কর্ণধারদের কিছুটা হলেও ভাবায়। তারা কিছু করবেন সড়কে গণহত্যা থামাতে। আমরা দেখতে চাই – পথ মানুষকে পৌঁছে দিক জীবনে। সড়ক যেন মৃত্যু-পথ হয়ে না দাঁড়ায়।
Comments