কেনো বাংলাদেশকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখতে চাই না

আমি বুঝতে শেখার পর ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসা বিএনপি'কেই প্রথম রাজনীতির মঞ্চে দেখি, এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের টালমাটাল দিন, রাজনীতির টানাপোড়েনের পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটের জয়ে সরকার গঠন করে। আমিও ততোদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। বড় দলগুলোর রাজনীতির বাইরে ভিন্ন ধারার একটি ছাত্র-রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরেও, দেশে বিদ্যমান অন্যান্য দলগুলোর বিবেচনায় মন্দের ভালো, এবং মুক্তিযুদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদী (পড়ুন 'বাংলাদেশবাদী') রাজনীতির কারণে আওয়ামী লীগকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করি।
সেসময় আওয়ামী লীগ সরকারের ছোট ছোট নানা উদ্যোগ, ইতিবাচক পরিবর্তনের কারণে দলটির প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন সমর্থন তৈরি হয় আমার মনে। সময়ের পরিক্রমায়, গঙ্গা-যমুনায় নানামুখী জল গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগের রাজনীতিও কলুষিত হয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের ক্ষমতার মোহ, আর চাটুকার নেতা-কর্মীদের ভিড়ে।
ধরাকে সরা জ্ঞান করা পাড়ার পাতি মাস্তান থেকে শুরু করে সচিবালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাও দলটির ছত্রছায়ায় নিজেদের আখের গুছিয়েছেন, আর প্রান্তিক মানুষের জীবনে বেড়েছে নাভিশ্বাস। 'আমরা আর মামুরা' মিলে খাই-খাই রাজনীতির প্রয়োজনে বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধ আর মানুষের আবেগকে ব্যবহার করেছে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনা বাংলাদেশে হয়ে উঠেন Cult Figure। পরপর তিনটি নির্বাচনে জনগণের ভোট কেড়ে নিয়ে, নেতাকর্মীদের শত শত কোটি টাকা পাচারের সুযোগ করে দিয়ে দলটির নেতারা এদেশের সাধারণ মানুষের গণশত্রুতে পরিণত হয়।
২০২৪-এ নিজেদের শোধরে নেওয়ার সুযোগ থাকলেও, জনবিচ্ছিন্ন রাজনীতি, চাটুকার শীর্ষ নেতাদের ঔদ্ধত্য/আস্ফালন, আর megalomaniac শেখ হাসিনার ক্ষমতার মোহ তাদের আর সেদিকে ধাবিত করেনি। এর ফলাফল ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থান।
গত বছর জুলাই-আগস্টে আন্দোলনের সময়টিতে আমার রিসার্চের কাজে বাংলাদেশে ছিলাম। প্রতিদিনের নানা ঘটনাপ্রবাহ কাছ থেকেই দেখেছি। জনজোয়ারে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভেবেছিলাম এবার বুঝি সত্যিই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু, সেদিনই গণভবনে সাধারণ মানুষের লুটপাট, আর সন্ধ্যার পর দেশের নানা প্রান্তে স্থানীয় আওয়ামী নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা-সহিংসতার ঘটনা দেখে আমার সেই উচ্ছ্বাস আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর যারা কিছুটা পরিবর্তন আশা করেছিলেন, তাদেরও এতোদিনে মোহভঙ্গ হওয়ার কথা। ১১ মাসেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা তারা দিতে পারেনি। শেখ হাসিনা ও আওয়ামী নেতাকর্মীদের বিচার-ধরপাকড়ে এই সরকারকে যতোটা তৎপর দেখা গেছে, তার কিছুটাও যদি পাড়া-মহল্লা/হাইওয়ে/মার্কেটের চাঁদাবাজ আর মবসন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে দেখা যেতো- মানুষ নিশ্চয়ই সরকারকে বাহবা দিতো। যে খুন-সহিংসতার ঘটনাগুলো ঘটেছে- এতে সরকারের পরনের শেষ লেঙ্গটটিও আর থাকলো বলে মনে করছি না।
বাংলাদেশের গণমাধ্যম কোনো এক অজানা কারণে, এই সরকারের জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে- এমন বিষয়গুলোতে প্রশ্ন তুলছে না। যেমন- বিএনপি-জামায়াতের মাঠ দখলের লড়াইয়ে যারা প্রকাশ্যে সহিংসতা, চাঁদাবাজি করছে- তাদের কেনো ধরা হচ্ছে না? আওয়ামী সরকারের পতনের পরপর যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে পালিয়েছিলো তাদের সন্ধান এবং বিভিন্ন থানা থেকে যেসব অস্ত্র লুট হয়েছে- সেগুলো কেনো উদ্ধার করা গেলো না? গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-মাঠে ধর্মের ঠিকাধারীর নামে কাঠমোল্লাদের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে হস্তক্ষেপ, নারীবিদ্বেষী কথা-বার্তা কেনো বন্ধ করা যাচ্ছে না? সারাদেশে মহামারির মতো ছড়িয়ে-পড়া মব-ভায়োলেন্স যদি নিয়ন্ত্রণ করা না-ই গেলো- তাহলে পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনা-অফিসারদের নেতৃত্বে মাঠে-থাকা খাকি-পোশাকীদের কাজটা কী? রাখাইনের জন্য করিডোর, চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবস্থাপনার কাজ বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়া, এবং ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় স্থাপনে এই অস্থায়ী সরকারের এতো আগ্রহ কেনো? ২৪-এর আন্দোলন/অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আওয়ামী-সরকারের পতন, এবং পরবর্তীতে অন্তর্বর্তী সরকারে কারা উপদেষ্টা হবেন, সরকার দেশ পরিচালনায় কী কী সিদ্ধান্ত নেবে- এইসব ব্যাপারে 'ডিপস্টেট' (আমার ভাষায়- অদৃশ্য হাত) জড়িত থাকার যে অভিযোগ- সে বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা, প্রেস সচিব, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানরা কেনো ঝেড়ে কাশছেন না?
দীর্ঘ আলাপের পর এবার আসল কথায় আসি- লেখার শুরুতে বলেছি- কেনো আমি বাংলাদেশকে নিয়ে আর স্বপ্ন দেখতে চাই না। এই কারণগুলোই একে একে বলছি। আমি বুঝে গেছি- এদেশের মানুষ এখন ক্রমেই প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ওঠছে; সহিষ্ণুতা/সহানুভূতি/সমানুভূতির মতো বিষয়গুলো আর আমাদের social fabric এর অংশ নয়। ক্ষমতা আর ব্যক্তিগত লাভালাভের প্রয়োজনে এদেশে সজ্জন বলে পরিচিত ব্যক্তিটিও অত্যন্ত দুর্নীতিপরায়ণ হতে পারেন, চোর-বাটপারের সঙ্গে হাত মেলাতে পারেন। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, শিগগিরই তা গড়ে ওঠবে বলে আশা করছি না। এতোবছরেও সাংবিধানিকভাবে দেশে ক্ষমতার কাঠামোতে ভারসাম্য আনা যায়নি- যা দুর্বল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করার বদলে আরও ত্বরান্বিত করেছে। এই সরকারের সংস্কার কমিটিও ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে করছি না। হাড়-হাভাতের এই দেশে নীতি-নৈতিকতার কথা বলে, আপনাকে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখিয়ে যারা পদ-পদবি পাবে, ক্ষমতার কাছাকাছি যাবে- তারা দেশ/মানুষের কথা না ভেবে নিজের পকেটটাই আগে ভারী করবে। জুলাই আন্দোলনের 'সম্মুখযোদ্ধা'দের কয়েকজনের হঠাৎ চাকচিক্য তা আরও একবার সত্যি প্রমাণ করলো।
ছোটবেলা থেকেই প্রতিদিনের ছোট-বড় নানা ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করে, বড় হয়ে যখন চারপাশটাকে বুঝতে শিখেছি- জানলাম- একে 'সংবেদনশীলতা' বলে। পরিবার, কর্মক্ষেত্র ও সামাজিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিদিন নানা মানুষের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া করতে হয়, আড্ডা-গল্পে নানা প্রসঙ্গ ওঠে আসে। আমি এসব খুচরো আলাপে দারুণ মিশে গেলেও যখন একাকী হই, নানা মানুষের প্রাত্যহিক ছোট-বড়, সুখ-দুঃখের গল্প আমাকে নাড়া দেয়, ভাবায়। নিজে নিজেই সেই সব ঘটনা/সমস্যার একটা উপসংহার দাঁড় করানোর চেষ্টা করি। ভাবি- এটা এভাবে না হয়ে ওভাবে হলে বোধ হয় ব্যাপারটা মিটে যেতো। কিন্তু সমাজ-বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে অনেক গল্পই আর সেই উপসংহারে পৌঁছায় না, নানাবিধ সমস্যার সবকিছু হয়তো আমাদের নিয়ন্ত্রণেও নেই। একজন বিষয়টিকে যেভাবে দেখি, অন্যজন হয়তো সেভাবে দেখে না, হয়তো বিপরীত পাশে থাকা মানুষটির সামষ্টিক লাভালাভের সঙ্গেও মিলে না, হয়তোবা তার উপলব্ধি, জীবনবোধও তাকে সমস্যাটির সমাধানে আগ্রহী করে তোলে না। এ এক রহস্যময় গোলকধাঁধা!
দেলোয়ার হোসেন : পিএইচডি ফেলো, সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, নয়া দিল্লি।
Comments