তিন দিনেও অধরা প্রধান দুই অভিযুক্ত
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদিকে গুলির ঘটনায় প্রধান দুই সন্দেহভাজনকে চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তারা হলেন, ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ফয়সাল করিম মাসুদ ও আলমগীর হোসেন ওরফে আলমগীর শেখ। তিন দিন কেটে গেলেও প্রধান দুই সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা যায়নি।
গত শুক্রবার মতিঝিল এলাকায় গণসংযোগ করে ফেরার পথে বেলা ২টা ২৪ মিনিটে পুরানা পল্টনের বক্স কালভার্ট সড়কে চলন্ত ব্যাটারিচালিত রিকশায় থাকা অবস্থায় ওসমান হাদিকে গুলি করা হয়। বর্তমানে তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। তাঁর অবস্থা অত্যন্ত সংকটজনক।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, হাদিকে গুলি করেন ফয়সাল। আর ঘটনার সময় ফয়সালকে বহনকারী মোটরসাইকেলটি চালাচ্ছিল আলমগীর। একটি সূত্র বলছে, গুলির ঘটনার ১২ ঘণ্টার মধ্যেই ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছে তারা। যদিও পুলিশের আনুষ্ঠানিক ভাষ্য, তাদের দেশ ছাড়ার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
হাদি হত্যাচেষ্টার ঘটনায় পৃথক অভিযানে ছয়জনকে আটকের কথা গতকাল রোববার জানিয়েছে পুলিশ ও র্যাব। এর মধ্যে গুলির সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির মালিক হিসেবে আবদুল হান্নান নামের একজনকে র্যাব-২ গ্রেপ্তার করেছে। গতকাল রোববার তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ ছাড়া মূল অভিযুক্ত ফয়সালের স্বাক্ষর করা কিছু চেকবই, ইলেকট্রনিক ডিভাইসসহ সন্দেহভাজন তিনজনকে আটক করে র্যাব। তারা হলেন– ফয়সালের স্ত্রী সামিয়া, শ্যালক শিপু ও বান্ধবী মারিয়া। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করা হয়।
এ ছাড়া সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে লোক পারাপারে জড়িত থাকার অভিযোগে শেরপুরের নালিতাবাড়ী থেকে আটক করা হয়েছে দুজনকে। তারা হলেন সিবিয়ন দিও ও সঞ্জয় চিসিম।
এদিকে, হাদিকে আজ সোমবার দুপুরে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে সিঙ্গাপুরে নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার। রোববার রাতে প্রধান উপদেষ্টার ফেসবুক পেজে এ তথ্য জানানো হয়।
১২ ঘণ্টার মধ্যে সীমান্ত পার?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, হাদিকে গুলি করা ফয়সাল করিম মাসুদ ওরফে দাউদ খান শুক্রবার রাত ২টার দিকে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া সীমান্ত দিয়ে ভারতের মেঘালয়ে পালিয়ে যায় বলে তারা তথ্য পেয়েছেন। তার সঙ্গে আলমগীর হোসেন শেখও পালিয়েছে।
ওই কর্মকর্তা জানান, গুলির ঘটনার আগের দিন বৃহস্পতিবার নরসিংদীতে ছিল ফয়সাল ও আলমগীর। শুক্রবার সকালে তারা উবার থেকে সারাদিনের জন্য ভাড়া করা প্রাইভেটকারে ঢাকায় আসে। দুপুর ১টার দিকে ফয়সাল ও আলমগীর মোটরসাইকেল নিয়ে পল্টন এলাকার দিকে যায়। সেখানে জুমার নামাজ আদায়ের পর হাদি জনসংযোগ করছিলেন। ফয়সাল ও আলমগীর তখন হাদির সঙ্গে ভিড়ে মিশে যায়; লিফলেটও বিতরণ করে।
সিসিটিভি ফুটেজ অনুযায়ী, হাদি রিকশায় রওনা হওয়ার পর আলমগীর মোটরসাইকেলে পিছু নেয়। তার পেছনে বসে শুটার ফয়সাল। হাদিকে বহন করা রিকশাটি শুক্রবার দুপুর সোয়া ২টার দিকে বিজয়নগর বক্স কালভার্ট রোডে পৌঁছালে চলন্ত মোটরসাইকেল থেকে হাদির ডান কানের নিচে গুলি করে ফয়সাল।
সূত্র বলছে, গুলির পর ফয়সালকে বহন করা মোটরসাইকেল পল্টন মোড় হয়ে হাইকোর্ট মৎস্য ভবন এলাকা পেরিয়ে তেজগাঁও আসে। সেখান থেকে উবারের ভাড়া করা গাড়িতে সাভার এলাকায় যায়। এরই মধ্যে সেই গাড়ির চালকের সন্ধান পেয়েছে পুলিশ। রাতে তারা আরেকটি গাড়িতে করে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট যায়। সেখানে দুই দালাল শুক্রবার রাত দেড়টা থেকে ২টার মধ্যে সীমান্ত পার করে দেয়।
সঞ্জম চিসিম এবং সিবিয়ন দিওকে এরই মধ্যে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে যুক্ত আরেকজন পলাতক রয়েছেন।
অপর একটি সূত্র বলছে, দুজনকে ভারতে পালাতে সহায়তার কথা স্বীকার করেছে সঞ্জয় ও সিবিয়ন। তবে তাদের দাবি, ফয়সাল ও আলমগীরের পরিচয় জানতেন না।
বিদেশে পালানোর তথ্য নেই: পুলিশ
সঞ্জয় চিসিম এবং সিবিয়ন দিওকে আটকের বিষয়ে জানাতে গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) এস এন নজরুল ইসলাম বলেন, আটক দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে হাদির ওপর হামলায় জড়িতদের গতিবিধি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে গুলির সময় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি জব্দ করা হয়েছে।
আটক দুজনের ব্যাপারে তিনি বলেন, 'আমাদের কাছে যেটুকু তথ্য আছে, তা হলো তারা ইমিগ্রেশন চ্যানেলের বাইরে, অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার করে থাকে। তাই তাদের কাছে এ ধরনের কোনো তথ্য আছে কিনা, সেটি জানতে আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করব।'
হাদির ওপর হামলার কারণ জানতে চাইলে পুলিশের এ কর্মকর্তা বলেন, 'আমাদের কাছে যেটা মনে হচ্ছে, হাদি ইনকিলাব মঞ্চের অন্যতম সংগঠক। তো যারা এই সংগঠনের প্রতিপক্ষ, যারা এটাকে পছন্দ করে না তারাই এই হামলা করেছে।'
আসামিদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার খবর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, 'আমাদের ইমিগ্রেশন ডেটাবেজ চেক করে এখন পর্যন্ত তাদের পালিয়ে যাওয়ার কোনো তথ্য মেলেনি। আমরা ফয়সালের পাসপোর্ট নম্বর পেয়েছি। সেটা ব্লক করা হয়েছে। তার সর্বশেষ যে ট্রাভেল পাওয়া গেছে, সেটা জুলাইয়ে; সম্ভবত থাইল্যান্ড থেকে দেশে এসেছে। এরপর তার দেশ ছাড়ার আর কোনো তথ্য নেই। আমরা বিজিবিকে সতর্ক করেছি, সীমান্ত দিয়ে যেন এ রকম পারাপার না হয়ে যেতে পারে। সে বিদেশে পালিয়েছে– এই তথ্যটা যেহেতু আমাদের কাছে নিশ্চিত না, তাহলে আমরা ধরে নেব যে দেশে আছে।'
গুলির ঘটনায় মামলা না হওয়া প্রসঙ্গে তিনি জানান, ভুক্তভোগীর স্বজন মামলা করলে খুব ভালো হয়। তবে তারা আসতে পারছেন না। রোববার রাতেও তাদের পক্ষ থেকে মামলা করা সম্ভব না হলে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। এ ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা আছে।
শনিবার রাত থেকে 'অপারেশন ডেভিল হান্ট ফেজ-২' শুরু হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ কাজ করছে। তবে নগরবাসীরও দায়িত্ব রয়েছে। আশেপাশে কোনো দুষ্কৃতিকারীকে দেখলে বা তথ্য থাকলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
মোটরসাইকেলের মালিক রিমান্ডে
গুলির ঘটনায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটির মালিক আবদুল হান্নানকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। এর আগে গতকাল মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকা থেকে তাঁকে আটক করে পুলিশে হস্তান্তর করে র্যাব। তাঁকে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন পল্টন মডেল থানার এসআই সামিম হাসান। শুনানি শেষে আদালত তাঁর তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
এর আগে শুনানিতে হান্নান বলেন, 'আমি মিরপুর মাজার রোড থেকে মোটরসাইকেলটি কিনেছিলাম। হাতে সমস্যা হওয়ায় পরিবার থেকে বাইক চালাতে নিষেধ করে। সেটি বাসায় পড়ে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে ভেবে একটি শোরুমে বিক্রি করি। আমি নাম পরিবর্তন করে দেব বলেছিলাম। সে জন্য তারা দুই মাস আগে কল দিয়েছিল। কিন্তু অসুস্থ থাকায় আমি যেতে পারিনি।'
আলমগীরের পরিবারের দুই সদস্য আটক
হাদিকে গুলির ঘটনায় 'শুটার' ফয়সালের সহযোগী আলমগীর হোসেনের পরিবারের দুই সদস্যকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হেফাজতে নিয়েছে বলে জানা গেছে। আদাবরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় থাকে আলমগীরের পরিবার। সেখানে গেলে প্রতিবেশীরা জানান, আলমগীরের মা ও বোনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে একটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
আর আদাবরের শেখেরটেক এলাকায় ফয়সালের বাসায় এখন কেউ থাকে না। তারা কে কোথায় আছে বলতে পারেননি প্রতিবেশীরাও। তারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ফয়সাল ছিল প্রভাবশালী। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইয়াসিন মোল্লার ছেলে স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা কাওছার মোল্লার ঘনিষ্ঠজন ছিল ফয়সাল। তার দায়িত্বে ছিল কাওছারের একাধিক টর্চার সেল।
Comments