পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইসলামের প্রভাবশালী মাওলানা ফজলুর রহমান বাংলাদেশ সফরে
সাত দিনের সফরে বাংলাদেশে এখন পাকিস্তান জমিয়তে উলামা ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফজলুর রহমান। এক সপ্তাহের সফরে বাংলাদেশে এসেছেন তিনি। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান বাংলাদেশ জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা উবায়দুলাহ ফারুকসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
পাকিস্তান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সরকারের পতনের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল লাখো জনতা। আজাদ মার্চ নামে ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এই মাওলানা ফজলুর রহমান। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
ইমরান খানের পদত্যাগ এবং পুনরায় নির্বাচন দাবিতে দুর্বার এ আন্দোলন গড়ে তুলে বিশ্বব্যাপী আলোচনা উঠে এসেছিলেন মাওলানা ফজলুর রহমান। ইমরান খানকে পদত্যাগের দুই দিনের আলটিমেটাম দিয়ে আলোচনায় উঠে আসেন ফজলুল রহমান । মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) ও পাকিস্তান পিপলস পার্টিসহ প্রায় সব বিরোধী দলই মাওলানা ফজলুর রহমানের এই আজাদি মার্চে সমর্থন দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে এমন প্রভাব বিস্তারকারীকে এই মাওলানা ফজলুর রহমান? কেন তার এই আজাদি আন্দোলনে পাকিস্তান জুড়ে এত লোক সমাগম ঘটে। কি তার রাজনৈতিক পরিচয়?
মাওলানা ফজলুর রহমানের জন্ম ১৯৫৩ সালের ২১ জুন। পবিত্র ঈদুল আজহার দিন শুক্রবার ডেরা ইসমাঈল খান জেলার আব্দুল খয়েল গ্রামে মুফতি মাহমুদের গৃহে জন্মগ্রহণ করেন তিনি।
মুলতানে মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে ১৯৭৩ সালে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন তিনি। এরপর ধর্মীয় শিক্ষার প্রতি মনোনিবেশ করেন। মুলতানের মাওলানা ক্বারী মুহাম্মদের কাছে কেরাত মশক করেন। এছাড়া দারুল উলূম হক্কানিয়া আকুড়াখটক মাদরাসায় অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে পড়াশোনা করেন।
রাজনৈতিক জীবন
বাবার হাত ধরেই রাজনীতিতে মাওলানা ফজলুর রহমানের আগমন হয়। ১৯৭৯ সালের ৯ নভেম্বর করাচির খালিকে দুনিয়া হলে মাওলানা প্রথম রাজনৈতিক বক্তব্য দেন। এই বক্তব্যে তিনি তৎকালীন সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হকের রাষ্ট্রপ্রধান পদে চ্যালেঞ্জ করেন। তার অনলবর্ষী বক্তব্যে অভিভূত হয়েছিলেন নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, যিনি পরে গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য এম আর ডি গঠন করেন। মাওলানা ফজলুর রহমান এ আন্দোলনে সক্রিয় হয়ে যান। এরপর থেকে জেলে যাওয়া-আসা শুরু।
১৯৮১ সালে তিনি যখন জেনারেল জিয়াউল হকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে কারাবন্ধি হন তখন তাকে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মহাসচিব নির্বাচন করা হয়। ১৯৯৫ সালের ২৮ মার্চ জামেয়া মাদানিয়া করিমপার্কে ৩২৫ সদস্যের অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে জমিয়ত সভাপতি হাফিজুল হাদিস আল্লামা আব্দুলাহ দরখাস্তি এর ইন্তেকালের পর মাওলানা ফজলুর রহমান সভাপতি নির্বাচিত হন। মাওলানা ফজলুর রহমান রাজনৈতিক মামলায় মোট ১০ বার কারাবরণ করেছেন।
জাতীয় নেতৃত্বে মাওলানা ফজলুর রহমান
মাওলানা ফজলুর রহমান ১৯৮৫ সালের নির্দলীয় ভোট প্রত্যাখান করেন। ১৯৮৮ সালের নির্বাচনের পরে বেনজীর ভূট্টো সেনা শাসনকে দাবিয়ে রাখার জন্য গোলাম ইসহাক খানকে রাষ্ট্রপতি মেনে নেন। তিনি রাষ্ট্রপতিকে স্বপদে বহাল রাখার পরিবর্তে খান আব্দুল ওয়ালী খানকে সঙ্গে নিয়ে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানকে রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
১৯৯৩ সনে বেনজীর ভূট্টো দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে মাওলানা ফজলুর রহমান জাতীয় সংসদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে যখন বেনজীর ক্ষমতাচ্যুত হন, তখন নওয়াজ শরীফের তদন্ত ব্যুরো সর্বশক্তি নিয়োগ করেও তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ উত্থাপন করতে পারেনি।
ইতোপূর্বে পাকিস্তানে ইসলামি অনেক দল ছিল, কিন্তু তা কোনও জাতীয় শক্তির রূপ ধারণ করতে পারেনি। মাওলানা ফজলুর রহমান ২০০২ সালে সব ইসলামী দল নিয়ে 'মুত্তাহিদা মজলিসে আমল বা এমএমএ' নামে একটি জোট গঠন করেন। যার সভাপতি ছিলেন বেরেলভীপন্থি মাওলানা শাহ আহমদ নূরানি এবং সেক্রেটারি বা মূখপাত্র ছিলেন তিনি নিজে। এতে জামায়াত, সিয়াসহ সব মত ও পথের লোকেরা তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হয় এবং এমএম এ'র ৭২টি আসন কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে জয়লাভ করে।
বাংলাদেশে আগমন পরবর্তী সময়ে মাওলানা ফজলুর রহমান বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রধান যোগ দিবেন। তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য সফরসূচি অনুযায়ী : বৃহস্পতিবার ১৩ নভেম্বর, রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ফিদায়ে মিল্লাত কনফারেন্সে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ১৪ নভেম্বর শুক্রবার ; রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আরজাবাদ মাদ্রাসার জামে মসজিদে জুমার নামাজের ইমামতি করবেন। ১৫ নভেম্বর : শনিবার রাজধানীর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আন্তর্জাতিক খতমে নবুওয়াত মহা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন। ১৬ নভেম্বর: রোববার মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান মধুপুর মাদ্রাসার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ১৭ নভেম্বর ; সোমবার সিলেট ঐতিহাসিক আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে আয়োজিত মহা সম্মেলনে প্রধান অতিথি বক্তব্য দেবেন। ১৮ নভেম্বর : মঙ্গলবার রাজধানীর বাংলাদেশ - চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের আয়োজনে অনুষ্ঠিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেবেন।
মাওলানা ফজলুর রহমানের এই সফরকে দুই দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলের নেতারা মনে করেন ইতিহাস সমৃদ্ধ বাংলাদেশের এই সফরে বিশেষ করে ইসলামী আন্দোলনের নেতাদের মধ্যে সৌহার্দ ও ঐক্যের নতুন এক দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
লেখক: সভাপতি, ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধ আন্দোলন
Comments