অমানবিকতার প্রতিচ্ছবি: অবলা প্রাণির প্রতি নৃশংসতা ও সমাজের নৈতিক সংকট
রাত সাড়ে এগারোটার নিস্তব্ধতায় সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও যেন নীরব অন্ধকারে বাজ ফাটার মতো এসে আঘাত করল—একটি গরুর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সেই গরুটির জিভ পুরোপুরি কেটে নিয়ে গেছে কিছু মানুষ। ভিডিওর সেই দৃশ্যটি শুধু একটি প্রাণীর যন্ত্রণার দলিল নয়, এটি আমাদের সমাজের মানবিকতার এক ভয়াবহ অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি।
সামাজিক মাধ্যমে ক্ষোভের ঢেউ বয়ে যায়, চোখের জলে ভিজে ওঠে স্ক্রিন—কিন্তু পরদিনই নতুন কোনো ঘটনা আমাদের মনোযোগ সরিয়ে দেয়। এভাবেই হারিয়ে যায় সহানুভূতির মুহূর্তগুলো। অথচ এই নির্মমতা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; এটি এক গভীরতর সামাজিক ব্যাধির অংশ—যেখানে সহানুভূতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে, অর্থনীতির নামে প্রাণিকে পণ্য বানানো হচ্ছে, আর নৈতিকতার জায়গায় বসছে নির্লিপ্ততা।
১. সহানুভূতির অবসান ও সমাজের রূপান্তর
এক সময় গ্রামীণ জীবনে গরু, ছাগল বা হাঁস-মুরগি ছিল পরিবারেরই সদস্যের মতো। শিশুরা তাদের আদর করত, বড়রা যত্ন করত। কিন্তু এখন তারা পরিণত হয়েছে নিছক মাংস, দুধ ও টাকার উৎসে। শিশু-কিশোরদের চোখে প্রাণির ওপর নির্যাতন আজ স্বাভাবিক দৃশ্য—টিভি, ভিডিও গেমস বা রাস্তার ধারে। মনোবিজ্ঞান বলে, এই সংবেদনশীলতা হারিয়ে গেলে মানুষ ধীরে ধীরে নিজের চারপাশের মানুষের প্রতিও নিষ্ঠুর হয়ে পড়ে। ইতিহাসও সাক্ষ্য দেয়—অসংখ্য গণঅপরাধীর নিষ্ঠুরতার শুরুটা হয়েছিল প্রাণির ওপর হাত তোলা দিয়েই।
২. অর্থনীতি ও নৈতিকতার সংঘাত
প্রাণি নির্যাতনের পেছনে অন্যতম চালিকা শক্তি হলো ভোগবাদী অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই ব্যবস্থায় প্রাণিকে দেখা হয় কেবল একটি 'সম্পদ'হিসেবে—যার সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে সর্বনিম্ন খরচে। তাদের যন্ত্রণা এখানে কোনো বিষয়ই নয়; এটি 'ব্যবসার খরচ'। এই মানসিকতা ধীরে ধীরে শিশুদের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে বিনোদনের নানা মাধ্যমে। দারিদ্র্য ও সামাজিক বৈষম্য অনেক সময় প্রাণীর প্রতি ক্ষোভের রূপও নেয়, যদিও মূল সমস্যা অর্থনৈতিক অবিচার।
৩. ধর্মীয় শিক্ষা ও আচরণের ফাঁক
সব প্রধান ধর্মেই অকারণ প্রাণী নির্যাতন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। ইসলামে বলা হয়েছে—একটি বিড়ালকে না খাইয়ে মারা জাহান্নামের কারণ, আবার একটি তৃষ্ণার্ত কুকুরকে পানি খাওয়ানো জান্নাতের কারণ হতে পারে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টধর্মেও একইভাবে করুণা ও দয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাদের সমাজে ধর্মের এই মূল শিক্ষাগুলো আচরণে খুব কমই প্রতিফলিত হয়। ধর্ম মুখে উচ্চারিত হলেও, হৃদয়ে তার স্থান কমে যাচ্ছে দিন দিন।
৪. আইনের অস্তিত্ব বনাম প্রয়োগের অভাব
বাংলাদেশে প্রাণি কল্যাণ আইন থাকলেও এর কার্যকর প্রয়োগ প্রায় নেই বললেই চলে। অভিযোগ দায়েরের জটিলতা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অনীহা এবং সামাজিক উদাসিনতা অপরাধীদের জন্য তৈরি করেছে নিরাপদ আশ্রয়। যতক্ষণ না কঠোর ও দ্রুত বিচার বাস্তবায়িত হচ্ছে, ততক্ষণ এই নির্মম সংস্কৃতি বদলানো সম্ভব নয়।
৫. মানসিক বিকৃতি ও সমাজে সহিংসতার ছায়া
মনোবিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রাণি নির্যাতন প্রায়ই গভীর মানসিক বিকৃতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দমিত রাগের বহিঃপ্রকাশ। যারা প্রতিবাদ করতে পারে না—তাদের উপর সহিংসতা চালিয়ে মানুষ নিজের বিকৃত আনন্দ খুঁজে নেয়। একটি অন্তঃসত্ত্বা গরুর জিভ কেটে নেওয়ার মতো নৃশংসতা কেবল অপরাধ নয়; এটি আমাদের সমাজে ছড়িয়ে থাকা এক ভয়াবহ মানসিক ও নৈতিক অসুস্থতার ইঙ্গিত।
৬. সামাজিক মাধ্যম: ক্ষণস্থায়ী উত্তাপ ও স্থায়ী পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ
সামাজিক মাধ্যম আজ ক্ষোভ প্রকাশের শক্তিশালী মাধ্যম। একটি ভিডিও ভাইরাল হলে মুহূর্তেই উত্তাল হয়ে ওঠে জনমত। কিন্তু কয়েকদিন পর সেই উত্তাপ মিলিয়ে যায়। স্থায়ী পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজন প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, চাপ সৃষ্টি, আইনি পদক্ষেপ ও শিক্ষা। প্রাণি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো—যেমন Obhoyaronno বা PAW Foundation—এই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু পর্যাপ্ত সমর্থনের অভাবে পথ কঠিন।
৭. শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতার অভাব
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পেশাগত সাফল্যের ওপর জোর দেয়, কিন্তু সহানুভূতি, করুণা বা প্রাণীর প্রতি দায়িত্ববোধ শেখানোর জায়গা ক্রমেই সঙ্কুচিত হচ্ছে। ফলে একটি প্রজন্ম বড় হয়ে উঠছে যারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যেতে জানে, কিন্তু মানবিক হতে শেখে না। নৈতিক শূন্যতা পূরণের জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রাণির প্রতি দায়িত্ব ও করুণা শেখানো জরুরি।
৮. নাগরিক দায়িত্ব ও পরিবর্তনের পথ
রাষ্ট্রের উদ্যোগ যেমন জরুরি, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ নাগরিক সমাজের ভূমিকা। তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে এলে, স্কুল-কলেজে সচেতনতা গড়ে উঠলে, প্রাণি উদ্ধার ও আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তুললে এবং গণআন্দোলনের মতো চাপ তৈরি হলে সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলো বাধ্য হবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে।
উপসংহার: মানবিকতার আসল মাপকাঠি
একটি সমাজের সভ্যতা মাপা যায় সে সমাজ কীভাবে তার সবচেয়ে নিঃস্ব ও অবলা সদস্যদের সঙ্গে আচরণ করে—মানুষ হোক বা প্রাণী। একটি গরুর চোখে অশ্রু কেবল তার যন্ত্রণার ভাষা নয়, তা আমাদের সমষ্টিগত বিবেকেরও পরাজয়ের সাক্ষ্য।
এই চিত্র বদলানো শুধু প্রাণির জন্য নয়—এটি আমাদের নিজের হারানো মানবিকতা পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। প্রশ্ন এখন শুধু একটাই—আমরা কি এই লড়াইয়ে নামতে প্রস্তুত?
Comments