নুসরাত ফতেহ আলী খান : কাওয়াল জগতের অমর কণ্ঠস্বর

নুসরাত ফতেহ আলী খান। আধ্যাত্মিকতার সুরে যার কণ্ঠ আজও অমলিন। নামটির মধ্যেই যেন এক অলৌকিক কম্পন। পাকিস্তানের এই কিংবদন্তি কাওয়াল শুধু দক্ষিণ এশিয়ার সঙ্গীতভুবনেই নয়, বিশ্বসঙ্গীতের আকাশেও রেখে গেছেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রচিহ্ন। তাঁর কণ্ঠের গভীরতা, আধ্যাত্মিক আবেগ এবং অনুভূতির বিস্তার তাঁকে করে তুলেছিল কাওয়ালির সম্রাট, 'শাহেন শাহ-এ-কাওয়াল"।
প্রজন্মের পর প্রজন্মের সুরে বেড়ে ওঠা
১৯৪৮ সালের ১৩ অক্টোবর, পাকিস্তানের লাহোরে জন্মগ্রহণ করেন নুসরাত ফতেহ আলী খান। তিনি এমন এক পরিবারের সন্তান, যেখানে কাওয়ালি ছিল প্রজন্মের ঐতিহ্য। তাঁর পিতা উস্তাদ ফতেহ আলী খান নিজেও ছিলেন প্রখ্যাত কাওয়াল। ছোটবেলা থেকেই নুসরাত সুর ও তালের মাধুর্যে বেড়ে ওঠেন। পরিবারের সঙ্গে কাওয়ালি পরিবেশনে অংশ নিতে তিনি নিজের গানে খুঁজে পান স্বতন্ত্র এক দিকনির্দেশ।
ওম্যাড উৎসব — বিশ্বজয়ের অনন্য সিঁড়ি
১৯৮০ সালের গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডের এসেক্সে অনুষ্ঠিত হয় ব্রিটিশ বিশ্বসঙ্গীত উৎসব (WOMAD)। সেদিন নুসরাতের পারফরম্যান্সের সময় ছিল মাত্র দেড় ঘণ্টা, কিন্তু তিনি গাইলেন সারারাত। প্রচণ্ড ঠাণ্ডার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন এক অজানা ভাষার গান। ভাষা না বুঝেও তাঁরা অনুভব করলেন সঙ্গীতের সার্বজনীন শক্তি। সে রাতেই প্রমাণিত হয়—সঙ্গীতের কোনো ভাষা নেই, এটি কেবল আত্মার ভাষা।
কাওয়ালির আধ্যাত্মিক দিগন্ত
নুসরাতের গানে মিশে থাকে সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভালোবাসা, আত্মিক শান্তির বার্তা এবং মানবজীবনের বিরহ ও অনুভূতির মর্মস্পর্শী প্রকাশ। তাঁর কণ্ঠের প্রতিটি ওঠানামা যেন কোনো এক অনাবিষ্কৃত আত্মার আর্তনাদ। শ্রোতারা সেই সুরে খুঁজে পান নিজস্ব প্রার্থনা, প্রেম এবং পরম সত্যের ছোঁয়া।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার
১৯৮৭ সালে পাকিস্তান সরকার তাঁকে প্রদান করে "প্রাইড অব পারফরম্যান্স"।
১৯৯৫ সালে অর্জন করেন ইউনেস্কো মিউজিক প্রাইজ,
১৯৯৬ সালে মন্ট্রিয়েল ওয়ার্ল্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের গ্রান্ড পিক্স ডেস আমেরিকাস এবং একই বছরে ফুকুয়োকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ।
তাঁর সঙ্গীত ও জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে পাঁচটিরও বেশি আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টারি।
বিশ্বসঙ্গীতে সহযোগিতা
নুসরাত শুধু পূর্বের নয়, পশ্চিমা সঙ্গীতেরও সেতুবন্ধন ঘটান। Peter Gabriel, Michael Brook, Eddie Vedder-এর মতো বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করে তিনি কাওয়ালিকে বৈশ্বিক সীমানায় পৌঁছে দেন। তাঁর কণ্ঠ মিশে যায় হলিউডের চলচ্চিত্রেও—তাঁর সুরের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় ঈশ্বর, প্রেম ও মানবতার সম্মিলন।
অমর সৃষ্টিগুলো
তাঁর গাওয়া "Allah Hoo", "Tajdar-e-Haram", "Kali Kali Zulfon Ke", "Ye Jo Halka Halka Suroor Hai"—এসব গান আজও নতুন প্রজন্মের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। প্রতিটি গান যেন এক আধ্যাত্মিক যাত্রা, যেখানে শ্রোতা হারিয়ে যায় আত্মার গভীরে।
হারানো অ্যালবামের ফিরে আসা
তাঁর মৃত্যুর ২৭ বছর পর, ২০২৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর প্রকাশ হয় শেষ অ্যালবাম "Chain of Light"। এটি আসলে ১৯৯০ সালে রেকর্ড করা এক হারিয়ে যাওয়া সৃষ্টি, যা পরে 'Real World Records'-এর আর্কাইভে আবিষ্কৃত হয়। অ্যালবামটি প্রকাশের পর বিশ্বজুড়ে আবারও ফিরে আসে নুসরাতের সুরের জাদু।
বিদায়, তবু চিরজীবী
১৯৯৭ সালের ১৬ আগস্ট হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন নুসরাত ফতেহ আলী খান। জীবন সংক্ষিপ্ত হলেও সঙ্গীতে নুসরাতের প্রভাব অনন্ত। আজও তাঁর গান শুনলে মানুষ যেন নতুন করে বিশ্বাস পায়—সঙ্গীত কেবল সুর এবং তালের মিশ্রণ নয়, এটি আত্মার ভাষা, হৃদয়ের প্রতিষেধক।
নুসরাত ফতেহ আলী খান শুধু পাকিস্তানের নয়, সমগ্র বিশ্বের সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য এক আশীর্বাদস্বরূপ। তিনি প্রমাণ করেছেন—সঙ্গীত ধর্ম, ভাষা বা জাতি মানে না; এটি মানুষের হৃদয়ের সেতুবন্ধন।
জীবনানন্দ দাশ যেমন বলেছিলেন—
"পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় না আর।"
আজও মাঝরাতের নীরবতায়, আহত হৃদয়ের কোনো প্রান্তে তাঁর কণ্ঠস্বর জেগে থাকে—
"জিন্দা হ্যায় নুসরাত।"
Comments