খাগড়াছড়িতে গুলিতে নিহত ৩, গুইমারায় থমথমে পরিস্থিতি

খাগড়াছড়িতে পাহাড়ি কিশোরীকে ধর্ষণের ঘটনায় বিক্ষোভ ও সহিংসতাকে কেন্দ্র করে গতকাল রোববার গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। জেলার গুইমারা উপজেলায় এ ঘটনায় ১৩ সেনাসদস্য ও ৩ পুলিশ সদস্যসহ অন্তত ২০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। খাগড়াছড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
গুলিতে তিনজনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম রেঞ্জের উপমহাপুলিশ পরিদর্শক (ডিআইজি) আহসান হাবিব পলাশ। মৃত ব্যক্তিদের লাশ হাসপাতালে রয়েছে বলে তিনি জানান। তবে কার গুলিতে কীভাবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিচয় তিনি জানাতে পারেননি।
রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে দুষ্কৃতকারীদের হামলায় তিন পাহাড়ি নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়। এই বিবৃতিতে মেজরসহ ১৩ জন সেনাসদস্য, গুইমারা থানার ওসিসহ তিন পুলিশ সদস্য এবং আরও অনেকে আহত হওয়ার খবর জানিয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে।
মন্ত্রণালয় আশ্বস্ত করে বলেছে, এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে শিগগিরই তদন্তপূর্বক আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো অপরাধীকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
খাগড়াছড়ি জেলা সিভিল সার্জন মোহাম্মদ সাবের বলেন, গুইমারা থেকে তিনজন পুরুষের লাশ এসেছে খাগড়াছড়ি জেলা হাসপাতালে। তাদের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। সোমবার (আজ) সকালে ময়নাতদন্ত করা হবে।
জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন বিকাশ ত্রিপুরা (২৬), চিংকেউ মারমা (২৬) ও উগ্য মারমা (২২)।
চিংকেউ মারমার বাঁ পায়ের হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ হয়ে অপর পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।
সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ
পাহাড়ি এক কিশোরীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রতিবাদে 'জুম্ম-ছাত্র জনতা'র ব্যানারে গত শনিবার ভোর পাঁচটা থেকে অবরোধ কর্মসূচি চলছে। কর্মসূচির কারণে চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি, খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। গতকাল সকালে জেলার বিভিন্ন স্থানে সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে ও গাছের গুঁড়ি ফেলে বিক্ষোভ করেন অবরোধকারীরা।
গত মঙ্গলবার রাত নয়টায় প্রাইভেট পড়ে ফেরার পথে ওই কিশোরী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় বলে অভিযোগ ওঠে। ওই দিন রাত ১১টার দিকে অচেতন অবস্থায় একটি খেত থেকে তাকে উদ্ধার করেন স্বজনেরা। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে শয়ন শীল (২১) নামে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত।
অবরোধ চলাকালে গতকাল বেলা একটায় খাগড়াছড়ির গুইমারা উপজেলার রামেসু বাজারে আগুন দেওয়া হয়। আগুনে বাজারের বেশ কয়েকটি দোকান পুড়ে যায়। এ সময় বাজারের পাশে থাকা বসতঘরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাজারটি চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক থেকে প্রায় ১০০ গজ দূরে। বাজারে আগুন দেওয়ার ভিডিও ও ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে। ভিডিওতে আগুনে বাজারের দোকানপাট জ্বলতে দেখা যায়। দোকানমালিকদের অধিকাংশ পাহাড়ি বলে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর গুইমারা উপজেলায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এলাকাজুড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল আছে। এর আগে দুপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে অবরোধের সমর্থনকারীদের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় গুলির শব্দ শোনা যায়।
প্রত্যক্ষদর্শী মংসাজাই মারমা ও কংজরী মারমা জানান, অবরোধের সমর্থনে তারা খাদ্যগুদামের সামনের সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছিলেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এলে তাদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ওপর গুলি করেন। তারা বলেন, গুলির পরপরই লোকজন ভয়ে দিগ্বিদিক পালিয়ে যান। এরপর ২০-২৫ জন লোক এসে রামেসু বাজার ও বসতবাড়ি লুটপাট করেন এবং যাওয়ার সময় আগুন ধরিয়ে দেন। এসব লোকের সঙ্গে মুখোশ পরা লোকও ছিল।
এদিকে খাগড়াছড়ি শহরে গতকাল সকাল থেকে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। শহরের মোড়ে মোড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থান দেখা গেছে। বাজার ও বাজারের আশপাশে কোনো দোকানপাট খোলেনি। প্রয়োজনীয় কাজে যারা বের হচ্ছেন, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে নিরাপত্তা বাহিনী।
পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা প্রথম আলোকে বলেছেন, ১৪৪ ধারা জারির পরও এমন ঘটনা ঘটার কথা ছিল না। নিয়ম অনুযায়ী তিনজনের বেশি মানুষ জড়োই হতে পারবে না। অথচ সেখানে দল বেঁধে মানুষ মিছিল করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন এবং স্থানীয় নেতৃত্ব উভয়েরই ইমম্যাচিওচর (অপরিপক্ব) আচরণের জন্য এটা হয়েছে। কেউ তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করেনি।
অনির্দিষ্টকাল সড়ক অবরোধ
জুম্ম ছাত্র-জনতার ফেসবুক পেজে মিডিয়া সেলের নামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তিন পার্বত্য জেলায় অনির্দিষ্টকালের সড়ক অবরোধ ও সব ধরনের পর্যটন কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ থাকবে বলে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ধর্ষণ মামলার বাকি দুই আসামিকে গ্রেপ্তার, পাহাড়িদের ওপর হামলার বিচার নিশ্চিত করাসহ আট দফা দাবি জানানো হয়েছে।
Comments