পুজোর গান
শারদীয় দুর্গাপূজা মানেই পক্ষকালের উৎসব। ষষ্ঠীতে পুজো শুরু হলেও আনন্দের ঢেউ আরও সপ্তাহখানেক আগে মহালয়া থেকেই টের পাওয়া যায়। আমেজ শেষ হয় কোজাগরী পূর্ণিমা বা লক্ষ্মী পূজার মধ্য দিয়ে। পুজোয় ঢাক আর মাইকের ব্যবহার আনন্দের প্রধানতম অনুষঙ্গ। আশি বা নব্বই দশকের দিকে মাইক বেজে ওঠা মানেই পূজা শুরু হয়ে গেল, বাড়তি আনন্দ শিশু ও কৈশোর মনে। বড়রাও এর বাইরে নয়। হয়তো তাঁদের আনন্দটা প্রকাশ পেত না।
সাধারণত ষষ্ঠী পুজোর সকালে নইলে বিকেল থেকে মাইক বেজে ওঠে। আর তখন ঘরে থাকে কোন শিশু কিশোর! ভোঁ দৌড় দুর্গা বাড়ি পানে। কাদের কটি মাইক লাগল, কত দূর পর্যন্ত আওয়াজ শোনা যায় এসবের হিসাব নিকাশ চলতো। আর পাশের পূজা মণ্ডপের সঙ্গে ভালো গানের প্রতিযোগিতা। 'ওদের পূজায় ভালো গান বাজছে, তোমার ওসব গান নেই কেন', তা নিয়ে মাইকম্যানের কাছে অভাব অভিযোগের শেষ নেই।
আজকাল পত্রিকায় সঙ্কর্ষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এক নিবন্ধে লিখেছেন 'পুজোর গানের ইতিহাস শতবর্ষ পেরিয়ে গেছে। শারদীয়া দুর্গা উৎসব উপলক্ষে প্রথম পুজোর গান প্রকাশিত হয় ১৯১৪ সালে, গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে। প্রথম বছর প্রকাশিত হয়েছিল ১৭টি রেকর্ড। শিল্পী তালিকায় ছিলেন মানদাসুন্দরী, কৃষ্ণভামিনী, কে মল্লিক, অমলা দাসের মতো সেই সময়ের ডাকসাইটে শিল্পীরা। গ্রামোফোন কোম্পানি তখন বিদেশি কোম্পানী। প্রথম স্বদেশী মিউজিক কোম্পানি হিসেবে হিন্দুস্থান রেকর্ডস আত্মপ্রকাশ করল ১৯৩২-এ। কোম্পানির প্রথম পুজোর গানের রেকর্ডে শিল্পী তালিকায় ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। আরও ছিলেন অতুল প্রসাদ সেন, রেনুকা দাশগুপ্ত, অনুপম ঘটকের মতো শিল্পীরা। পুজোর নতুন রেকর্ড তো সেই কবেই বিদায় নিয়েছে। একে একে এসেছে ক্যাসেট, সিডি। ক্যাসেট যুগ চলে গেলেও, পুজোর নতুন গানের সিডি এখনও প্রকাশিত হয়।'
সেকেলে পূজায় সাধারণত বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠের মহিষাসুর মর্দিনী চন্ডীপাঠটি সব মণ্ডপেই বাজতো। এ ছাড়া আরেকটি অতি পরিচিত ভক্তিমূলক গান ভেসে আসত 'বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল রে ভুবন বাজল তোমার আলোর বেণু'। গীতিকার বাণী কুমার ও শিল্পী সুপ্রীতি ঘোষের গাওয়া গানটি এখনো শোনা যায়। আর এই সুরটি সবার মনে পূজার রং ধরিয়ে দেয়।
তখন পাড়ার বাবা দাদুদের আবদার থাকত ধর্মীয় গান বাজানো যেন হয়। তাই মাইকওয়ালার কাছে ভক্তিমূলক গানের রেকর্ড আছে কিনা সেটা যাচাই করে দেখা হতো। তবে তরুণদের আগ্রহ ছিল আধুনিক বাংলা গান বা হারানো দিনের পুরোনো গানের প্রতি। ভক্তিমূলক গান বাদ দিয়ে বাবা কাকাদের বকুনিও খেতে হয়েছে অনেক সময়। বিশেষ করে হিন্দি গান বাজালে রেগে আগুন হতেন তাঁরা।
বাংলা যেসব গান তখন বাজতো তার মধ্যে প্রাধান্য ছিল সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, লতা মঞ্জেষ্কর, হৈমন্তী শুক্লা, চিত্রা সিং, মান্না দে, শচীন দেব বর্মণ, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের মতো শিল্পীদের। অনেক বড় বড় শিল্পীর পুজো উপলক্ষে গানের রেকর্ড বা অ্যালবাম বের হতো। তাদের গাওয়া আধুনিক গানগুলোই হয়ে উঠেছিল পূজার গান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'ঘুম ঘুম চাঁদ', 'চন্দন পালঙ্কে শুয়ে' কিংবা হৈমন্তীর 'ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ধুয়ো না' গানগুলো বেশ জনপ্রিয় ছিল পাড়ার বিভিন্ন বয়সী বড় ছোটদের কাছে। তাই বড়দের সম্মান করে ভক্তিমূলক দিয়ে শুরু করেই দ্রুত এসব গান আধিপত্য বিস্তার করত পুজোর মাইকে।
আশির দশকের একেবারে শুরুর স্মৃতি মনে আছে। স্কুলে যাচ্ছি বছর দুয়েক আগে থেকে। পূজার মাইক ছিল তখন বালকমনের বিস্ময়। তাই মাইক বাজার সঙ্গে সঙ্গে দুর্গাবাড়িতে দৌড়। কীভাবে বাজানো হয় তা দেখতাম। এখনকার সিডির আদলে কালো বড় থালা আকৃতির কিছু রেকর্ডের মধ্য দিয়ে গান বাজানো হতো। কলের গান বলা হয়। মাইকওয়ালার কাছে কলের গানের রেকর্ড থাকত বেশ কিছু।
এসব রেকর্ডের মাধ্যমে শোনা যেত ভারতীয় বাংলা ছবির অনেক জনপ্রিয় গান। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের 'মধু মালতী ডাকে আয়', আরতি মুখোপাধ্যায়ের 'এক বৈশাখে দেখা হলো দুজনায়', হৈমন্তী শুক্লার 'আমার বলার কিছু ছিল না' গানগুলোতে যেন নিজেদের প্রেম ভালোবাসা বা বিরহের ভাষা খুঁজে পেত বাঙালি। বিরহের কথা এলে মান্না দে ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের উপস্থিতি অনিবার্য। 'সবাই তো সুখী হতে চাই', 'খুব জানতে ইচ্ছে করে', 'যদি কাগজে লেখো নাম, 'আবার হবে তো দেখা', 'কফোটা চোখের জল' - মান্না দের এসব গান মানেই যেন নস্টালজিক তারুণ্য। হেমন্ত বাবুর 'পথ হারাব বলে এবার', 'আমি দূর হতে তোমাকে দেখেছি', 'অলির কথা শুনে বকুল হাসে', 'আজ দুজনের দুটি পথ' ইত্যাদি গানগুলো তখন মুখে মুখে ফিরত।
ওই সময়টাতে মানুষের বিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সবার ঘরে রেডিও ছিল না। পাড়ার এক দুটি ঘরে রেডিও দেখা যেত। বেতারে এসব গানের পাশাপাশি বাংলাদেশি শিল্পীদের কিছু গান শোনা যেত। তাই পুজোর সময়টাতে বাজা মাইক পাড়া প্রতিবেশীর বিনোদনের একটা বড় উপলক্ষ। কলের গানের পর ক্যাসেট প্লেয়ারের যুগ চলে আসে। তখন গানগুলো আরও বেশি বেশি বাজতে থাকে। দেশের সিনেমার কিছু গানও পুজোয় বাজতো। অ্যান্ড্রু কিশোর, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লার গানও কোনো কোনো মণ্ডপ থেকে ভেসে আসত। 'সুবীর নন্দীর দিন যায় কথা থাকে' বা 'কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো'র মতো জনপ্রিয় গানগুলোও বাদ যেত না। তপন চৌধুরী ও মিতালি মুখার্জির দু একটা গানও শোনা যেত।
আরও যেসব গান শোনা যেত তার মধ্যে 'জীবনে দীপ যদি জ্বালাতে নাহি পারো', 'তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি' বা লতাজির 'মঙ্গল দীপ জ্বেলে অন্যতম। ভূপেন হাজারিকা, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, চিত্রা সিংয়ের কিছু জনপ্রিয় গানও একসময় পূজা বাড়ির গান হয়ে উঠেছিল। কেউ কেউ দু একটি রবীন্দ্র সংগীতও বাজাত। আর বাজতো কীর্তন। বিশেষ করে অনুপ জালোটার আজ মনে মনে লাগে হরি, কৃষ্ণ কৃষ্ণ গানগুলোতে মন পড়ে থাকত গ্রাম বাংলার। শচীন কর্তার 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই'তো বাজতই।
এভাবে পুজোর মাইকে বাজানো গানের মধ্য দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতির ধারায় বেড়ে উঠেছে কয়েকটি প্রজন্ম। ভালো গান শোনার কান তৈরি করেছে গ্রাম বাংলার পুজো। এখন পুজোর মাইকে এমন সুর খুব একটা ভাসে না।
লেখক : সাংবাদিক
Comments