চীনে ত্রিশক্তি মহড়া

আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গন এখন বহুমাত্রিক। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা বিশ্বব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়, অন্যদিকে এশিয়া ও ইউরেশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো নতুন জোট ও সমীকরণ তৈরি করছে। সম্প্রতি চীনে অনুষ্ঠিত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলন সেই বাস্তবতাকেই নতুনভাবে সামনে এনেছে। বিশেষভাবে চীন, রাশিয়া ও ভারতের শীর্ষ নেতৃত্বের উপস্থিতি শুধু কূটনৈতিক প্রদর্শনী ছিল না, বরং যুক্তরাষ্ট্র ও বিশেষত তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে উদ্দেশ্য করে একটি স্পষ্ট বার্তা।
বর্তমানে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যা ৮২০ কোটির মতো। এর মধ্যে রাশিয়া, চীন,ভারত ও তাদের সমমনা রাষ্ট্রগুলো মিলে জনসংখ্যা প্রায় ৪৫০ কোটিরও বেশি। এর অর্থ হলো বিশ্বের অর্ধেক মানুষের বাজার শুধু এই তিন দেশের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এবং এই বানিজ্যের সম্প্রসারণে অন্তরায় হয়ে ছিলো ভারত।
এখন এই ব্যাপক সংখ্যক বানিজ্য নতুন মোড় নিচ্ছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বানিজ্য যুদ্ধের কারণে। যে ভারত তাকে বন্ধু বন্ধু বলে শুরু থেকেই ট্রাম্পকে উদার হস্তে সব দিয়ে আসছিল, সেই ভারতের সাথে যখন ট্যারিফের নামে রাজনীতি করল ট্রাম্প তখন মোদির পক্ষে চীন যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। রাশিয়ার সাথে রসায়ন তো বরাবরই ছিল।
ট্রাম্প আধিপত্যবাদী মানসিকতা থেকে যে 'ট্যারিফ' কুটনীতি শুরু করেছিলেন, তাতে প্রায় সব দেশ এক প্রকার বশ্যতাই স্বীকার করে নিয়েছে। কিন্তু ট্রাম্প ভারতকে গতানুগতিক দাস মনে করেই ভুলটা করেছেন। ভারতকে অত্যধিক ট্যারিফ আরোপ করে যে লাভের কথা ভেবেছিলেন ট্রাম্প, তা বুমেরাং হয়ে তার নিজের দেশের দিকেই গিয়ে পড়েছে। ফলাফল, যে ভারত আর চীন কখনো বন্ধু হওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবেনি, তারাই এখন জোটবদ্ধ হয়ে ট্রাম্পের চোখে চোখ রেখে কথা বলছে।
এখন এক করে দেখা যাক এই ত্রিশক্তির মহড়া কী কী বিষয় সামনে আনল:
১. এককেন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে বহুমেরুকরণ
শীতল যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র কার্যত এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলে। কিন্তু গত দুই দশকে সেই কাঠামো নড়ে উঠেছে। চীন অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে উত্থিত হয়েছে, রাশিয়া সামরিক শক্তির পাশাপাশি জ্বালানি সম্পদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে, আর ভারত জনসংখ্যা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির কারণে একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে। এসসিও সম্মেলনে তাদের একত্রে দাঁড়ানো আসলে এই বার্তা দিয়েছে যে বিশ্ব আর ওয়াশিংটনের একক নিয়ন্ত্রণে নেই। ট্রাম্পের "আমেরিকা ফার্স্ট" নীতি যতই উচ্চকণ্ঠ হোক,এই ত্রিশক্তির উপস্থিতি সেই প্রভাবকে সীমিত করার ইঙ্গিত দেয়। পুতিন তো বলেই দিয়েছেন যে, ইউরোপ কেন্দ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার বাইরে তিনি চান একটি ইউরেশিয়ান নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে।
২. এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য
এশিয়া এখন বিশ্ব অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সিল্ক রোডের ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারকে ঘিরে চীনের "বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ", রাশিয়ার ইউরেশিয়ান অর্থনৈতিক ইউনিয়ন, আর ভারতের দক্ষিণ এশিয়া ও ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল - সবই আঞ্চলিক প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টা। এসসিও-তে এই তিন দেশের একত্র আসা আসলে একধরনের আঞ্চলিক সমন্বয়। এর মাধ্যমে বার্তা দেওয়া হচ্ছে, এশিয়ার নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও উন্নয়ন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাইরের শক্তি হিসেবে একক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না।
৩. মার্কিন চাপ ও নিষেধাজ্ঞার বিকল্প
রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা দীর্ঘদিনের। চীনের বিরুদ্ধে ট্রাম্প প্রশাসন বাণিজ্য যুদ্ধ শুরু করেছিল, আর ভারতের ক্ষেত্রেও ওয়াশিংটনের নীতি অনেকসময় দ্বিধান্বিত ছিল। এই পরিস্থিতিতে চীন-রাশিয়া-ভারতের ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট বার্তা দিল:পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বা চাপের বাইরে বিকল্প সহযোগিতার পথ আছে। জ্বালানি বাণিজ্য,সামরিক প্রযুক্তি,অবকাঠামো উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে এই ত্রিশক্তির নিজস্ব সহযোগিতা গড়ে উঠতে পারে। এতে ট্রাম্প বুঝতে পারবেন,যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা চাপ কৌশল সবসময় কার্যকর হবে না।
৪. রাজনৈতিক বার্তা
আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নেতাদের পাশাপাশি বসা বা যৌথ ঘোষণা সবসময় প্রতীকী হলেও তা গভীর রাজনৈতিক বার্তা বহন করে। চীনের প্রেসিডেন্ট,রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী একই মঞ্চে একে অপরের সাথে হাত মেলানো আসলে বৈশ্বিক দর্শকদের জন্য একটি দৃশ্যমান ইঙ্গিত। তারা দেখাতে চাইছেন যে দ্বিপাক্ষিক মতবিরোধ (যেমন ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা বা ভারত-রাশিয়ার পশ্চিমা সম্পর্ক) থাকলেও বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক স্বার্থে তারা একসাথে কাজ করতে প্রস্তুত। এই প্রতীকী ঐক্যই ট্রাম্পের জন্য সতর্কবার্তা।
৫. ভারতের অবস্থান: কৌশলগত ভারসাম্য
ভারত এখানে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। কারণ ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলেছে প্রতিরক্ষা চুক্তি, প্রযুক্তি বিনিয়োগ, এবং কৌশলগত সহযোগিতায়। কিন্তু একই সময়ে এসসিও সম্মেলনে রাশিয়া ও চীনের সাথে একত্রে অংশ নেওয়া মানে ভারত ওয়াশিংটনের শিবিরে একপেশে যাবে না। এটি ট্রাম্পকে বুঝিয়ে দিল যে ভারত নিজস্ব কূটনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করবে এবং তার জন্য বহু-পাক্ষিক জোটের সুযোগ নেবে।
৬. ট্রাম্পের জন্য বার্তা
এই ত্রিশক্তি মিলনের সবচেয়ে বড় বার্তা হলো যুক্তরাষ্ট্র আর একা বৈশ্বিক শক্তি নয়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এখন বহুমুখী, এবং প্রতিটি রাষ্ট্রই বিকল্প পথ খুঁজছে। ট্রাম্পকে বুঝতে হবে যে চাপ, নিষেধাজ্ঞা, কিংবা বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে সব দেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব নয়। বরং নতুন বিশ্বব্যবস্থায় বহুপাক্ষিক সমন্বয়ই কার্যকর হবে।
চীনে অনুষ্ঠিত এসসিও সম্মেলনে চীন, রাশিয়া ও ভারতের একত্রিত উপস্থিতি শুধু একটি আঞ্চলিক ঘটনাই নয়, বরং বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে এক নতুন বার্তা। ট্রাম্প ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এটি একটি সতর্ক সংকেত যে বিশ্ব রাজনীতিতে এককেন্দ্রিক আমেরিকান আধিপত্য আর কার্যকর নয়। এশিয়ার বৃহৎ শক্তিগুলো এখন নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করছে এবং বিকল্প শক্তি-বলয় গড়ে তুলছে। ফলে আগামী দিনের বিশ্বব্যবস্থা হবে আরো বহুমেরুকেন্দ্রিক,যেখানে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।
Comments