বিদেশি বউ আনতে নিষেধ করেছিলেন ইমরান খানের মা

ইমরান খান, পাকিস্তানের বিশ্বজয়ী অধিনায়ক, সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। সুদর্শন ইমরান ছিলেন ক্রিকেটের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পুরুষদেরও একজন। খেলোয়াড়ি জীবন ও অবসরের পর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন ইমরান, 'অলরাউন্ড ভিউ' তাঁর দ্বিতীয় আত্মজীবনী। যেখানে মূলত নিজের বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটে পথচলা, জীবনদর্শন, পাকিস্তানের সমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে লিখেছেন কিংবদন্তি এই ক্রিকেটার। প্রেম, বিয়ে ও খ্যাতি নিয়ে ইমরানের ভাবনা আছে একটা অধ্যায়ে। তবে পড়ার সময় পাঠকদের মনে রাখতে হবে, বইটা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৮ সালে। ভাবনাগুলোও সেই সময়ের।
কী লিখেছেন ইমরান খান
আমার জীবনে নেওয়া দুটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত হলো মদ্যপান না করা এবং বিয়ে না করা।
আমি বিশ্বাস করি, ক্রিকেট আর সংসারধর্ম একসঙ্গে চলে না। আমার মনে হয় না, যে মানুষটা সারা বছর ধরে সফরের মধ্যে থাকে, সে তার স্ত্রী আর সন্তানদের প্রতি সুবিচার করতে পারে। টানা চার মাসের সফরে বউকে কিছুদিনের জন্য সঙ্গে নিলেও লাভ হয় না—খেলোয়াড়েরা খেলার মধ্যেই ডুবে থাকেন, আর স্ত্রীদের মন খারাপ হয়, বিশেষ করে যখন স্বামীর চারপাশে নারী ভক্তরা ঘোরাফেরা করে এবং যদি স্বামী দেখতে আকর্ষণীয় হন।
আমি অনেক ক্রিকেটারকে চিনি, যাঁরা বিদেশ সফরে যেতে চাইতেন না। কারণ, তাঁরা অনুভব করতেন, এতে তাঁরা পারিবারিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। গ্রেগ চ্যাপেল যখন বিদেশে সফরে যেতে চাননি, কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, তাঁর বাচ্চারা তখন বড় হচ্ছিল, তিনি তাদের সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। অনেক কাউন্টি ক্রিকেটারের স্ত্রীরা অভিযোগ করেন যে তাঁদের কোনো পারিবারিক জীবন নেই; তাঁদের স্বামীরা হয় ক্রিকেট খেলছেন অথবা টানা খেলার ধকল সামলাচ্ছেন।
তা ছাড়া একজন পেশাদার খেলোয়াড়ের জীবন অনিশ্চয়তায় ভরা। খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর নতুন করে জীবন শুরু করাও তো চাপের। আমি নিশ্চিত যে আমার যদি স্ত্রী আর সন্তান থাকত, তাহলে ক্রিকেট-পরবর্তী জীবন নিয়ে আমি আরও বেশি উদ্বিগ্ন থাকতাম। তখন আমাকে আগে তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভাবতে হতো।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের হয়ে খেলতে ইংল্যান্ড যাওয়ার সময় আমার মায়ের শেষ কথা ছিল, 'কোনো বিদেশি বউ নিয়ে আসিস না।' তাঁর আশঙ্কা ছিল—পশ্চিমা মেয়ে আমাদের সংস্কৃতিতে মানিয়ে নিতে পারবে না, আর মানিয়ে নিতে না পারলে আমাকে নিয়েই ফিরে যাবে। যে কারণে আমি ঠিক করে রেখেছিলাম, আমার বড় মামাতো ভাইদের পথ অনুসরণ করব। তাঁদের তিনজন অক্স-ব্রিজে পড়াশোনা করে পাকিস্তানে ফিরে এসে পারিবারিকভাবে ঠিক করা পাত্রীকে বিয়ে করেছেন।
যদি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চক্করে না পড়তাম, তাহলে হয়তো আমিও বিয়ে করে ফেলতাম। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ায় পাকিস্তানে লম্বা সময় থাকার সুযোগই পেলাম না। যখন বয়স ৩০ হলো, আমার মনে হলো, এবার থিতু হওয়া উচিত। কারণ, আর বেশি দেরি করলে মেয়ে আর আমার বয়সের ব্যবধান অনেক বেশি হয়ে যাবে। কিন্তু কথাটা বলা যতটা সহজ, বাস্তবে সেটা অনেক কঠিন।
যখন আমি পারিবারিকভাবে বিয়ে করার ব্যাপারে মনস্থির করছিলাম, তখনই এক ব্রিটিশ মেয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ি। এমনকি এই সম্পর্কের দীর্ঘমেয়াদি অবাস্তবতা নিয়ে অনেক যুক্তি থাকার পরও তাঁকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করলাম। তখন আমি উপলব্ধি করলাম, যেখানে আবেগ জড়িয়ে যায়, সেখানে যুক্তির কোনো জায়গা নেই। দুঃখজনকভাবে, সাংস্কৃতিক পার্থক্য আর দীর্ঘ সফর-জীবনের কারণে আমাদের সেই সম্পর্ক ভেঙে যায়। তখন বুঝলাম—কখন, কাকে বিয়ে করব, তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
আমার বিশ্বাস—ভালোবাসার বিয়ে হোক বা দেখাশোনা করে, সংসার টিকিয়ে রাখতে পরিশ্রম লাগে। দেখাশোনা করে বিয়ের সাফল্যের হার বেশি—কারণ, প্রত্যাশা কম থাকে, পরিবার চাপ দিয়ে হলেও সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। পাকিস্তানি সমাজ পরিবারমুখী। ভালোবাসার বিয়েতে যদি একপক্ষ ভালোবাসা হারায়, বাকি কিছু থাকে না। যেকোনো বিয়ে সফল হয় মূলত বন্ধুত্বের ওপর ভিত্তি করে, যা দুই ধরনের বিয়েতেই হতে পারে। তবে জীবনের অন্যান্য বিষয়ের মতো, বিয়ে সফল হতেও ভাগ্যের প্রয়োজন হয়।
বিদেশে থাকা পাকিস্তানিদের জন্য আমার খারাপ লাগে। তাঁদের প্রজন্ম দ্বিধায় ভুগছে—ছেলেমেয়েরা ইংরেজি স্কুলে পড়ে পশ্চিমা আদর্শ নিয়েছে, আর মা-বাবা আঁকড়ে ধরে আছেন প্রাচ্যের মূল্যবোধ। সমস্যা হয়, যখন পশ্চিমা শিক্ষিত মেয়েদের বিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানের গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে—যাঁদের মধ্যে কোনো মিলই নেই। কে জানে, হয়তো পরের প্রজন্মে পরিস্থিতি বদলাবে।
ব্রিটেনে জন্মানো অনেক পাকিস্তানিও ব্রিটিশ সমাজের সঙ্গে মিশে যাবে কি না, এই দ্বিধায় ভোগে। তারা জাতিগত বৈষম্যে আক্রান্ত হয়, ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়, আবার পাকিস্তানে গিয়েও নিজেদের মেলাতে পারে না। আমার এক বন্ধু (১৯৮৭) বিশ্বকাপের সময় পাকিস্তানে এসে এমন অসুস্থ হলো, বলল, আর কখনো এই দেশে আসবে না। তবে তরুণ প্রজন্মের পাকিস্তানিরা তাদের বাবা-মায়ের চেয়ে আলাদা। তারা ইংল্যান্ডে থাকার জন্য কোনো অনুশোচনা বোধ করে না। তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন, অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। ১৯৭১ সাল থেকে আমি টেস্ট খেলার মাঠে পাকিস্তানি সমর্থকদের আচরণে পরিবর্তন দেখেছি। তবে দুঃখজনকভাবে, অনেক সময় মনে হয় তারা ক্রিকেট উপভোগ করতে নয়, নিজেদের ইংরেজদের সমকক্ষ প্রমাণ করতে আসে।
শৈশবে আমার বড় বোন বলত আমি নাকি দেখতে ভালো না। আমি ওর কথায় কিছুদিন মন খারাপ করে থাকলেও পরে ক্রিকেট আর শিকার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এতটাই নিজের জগতে ডুবে ছিলাম যে একদিন আমার চিন্তিত মা আমার বড় বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমি স্বাভাবিক শিশু কি না। তাই যখন আমাকে প্রথম 'সুদর্শন' বলা শুরু হলো, আমি খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার ধারণা, আমি ক্রিকেটে সফল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এটা শুরু হয়েছিল।
আমার খ্যাতি নিয়ে আমি নিজেই বিস্মিত—তবে স্বীকার করি, প্রশংসা পাওয়ার আনন্দ অন্য রকম। মা-বাবা সব সময় আমার এই খ্যাতিকে ছোট করে দেখেছেন। যখনই আমি বাড়িতে সফলতার বড়াই করতাম, তখন মা-বাবা দুজনেই কোরআনের এই আয়াতটি বলতেন, 'সব সম্মান ও অসম্মান আল্লাহর হাতে'।
১৯৭৯ সালের ভারত সফরে আমি প্রথম বুঝলাম অনেক বিখ্যাত হয়ে গেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম, নিশ্চয়ই ভুলে আমাকে কারও সঙ্গে মেলানো হচ্ছে! তখনই শিখলাম—যতক্ষণ পারফরম্যান্স ভালো, ততক্ষণ দল আলো সহ্য করে; পারফরম্যান্স নামলেই সমালোচনা শুরু। উপমহাদেশে ক্রিকেট এমন এক গ্ল্যামার যে খ্যাতি অনেক বেশি পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের হয়ে খেললে এত পেতাম না। একজন বহির্মুখী মানুষের জন্য এই খ্যাতি উপভোগ্য হতে পারে, কিন্তু আমি লাজুক প্রকৃতির হওয়ায় আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগত। সব সময় ভিড়ের নজর পছন্দ করি না।
যখন আমি প্রথমবার পাকিস্তান দলে ডাক পেয়েছিলাম, সেদিন আমার বাবা বুঝেছিলেন, আমি ক্রিকেটে ভালো। তবে তিনি সব সময় আমার খ্যাতিটা তুচ্ছ করে দেখেছেন, যাতে আমার মধ্যে অহংকার না চলে আসে।
একদিন আমি তাঁর সঙ্গে আমাদের জমির ফসল দেখতে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পথে আমি ভিড় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করছিলাম। তিনি তখন আমাকে বলছিলেন, নিজের খ্যাতি সম্পর্কে আমার মাত্রাতিরিক্ত উচ্চ ধারণা তৈরি হয়েছে এবং সেটা মাথায় ঢুকে গেছে। তাই আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি জোর দিয়ে বললেন, 'আমরা যে রেস্টহাউসে রাত কাটাব, তার কাছেই একটি লোকজনে ভরা রেস্তোরাঁয় খাব।'
পরদিন সকালে আতঙ্কিত চৌকিদার আমাদের ঘুম ভাঙালেন। এসে বলতে লাগলেন, যদি আমি বাইরে না যাই, তাহলে লোকজন আমাকে দেখতে সামনের দরজা ভেঙে ঢুকে যাবে। আমি বাবাকে নিয়ে বাইরে গেলাম, হাজার হাজার মানুষ সেখানে অপেক্ষা করছে আমাকে দেখার জন্য। বাবা সত্যিই বিস্মিত হয়েছিলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি টেলিভিশনের কল্যাণে ক্রিকেট পাকিস্তানের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে গেছে।
তারপরেও বাবা-মা আমাকে সব সময় শিখিয়েছেন—খ্যাতি যতই হোক, পা মাটিতে রাখতে হবে। কারণ, মানুষের স্মৃতি স্বল্পস্থায়ী, প্রশংসাও ক্ষণস্থায়ী।
পাঠকের জন্য তথ্য
একসময় যিনি বিয়েই করতে চাননি, সেই ইমরানের কথিত প্রেমিকাদের তালিকাটা অবশ্য বেশ দীর্ঘ। জিনাত আমান, রেখা, মুনমুন সেন, এমা সার্জেন্ট, সুসান কনস্টানটাইন, সিতা হোয়াইট…কতজনের সঙ্গে যে জড়িয়েছে পাকিস্তানি এই অলরাউন্ডারের নাম। এমনি এমনি তো আর সুনীল গাভাস্কার এক সাক্ষাৎকারে মজা করে জানতে চাননি, 'প্রেমিকা না টেস্টের উইকেট, কোনটা বেশি তোমার?' পাঠকদের জন্য সম্পূরক তথ্য, ইমরান খানের টেস্ট উইকেট সংখ্যা ৩৬২।
ইমরানের মা বিদেশি বউ চাননি, তবে শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালে ইমরান প্রথম বিয়ে করেন এক বিদেশিকেই, ব্রিটিশ ধনকুবের ও মিডিয়া পার্সোনালিটি জেমিমা গোল্ডস্মিথ। এই দম্পতির দুই সন্তান, সুলাইমান ও কাশিম। ৯ বছর টিকেছিল সেই বিয়ে, ইমরান-জেমিমার বিচ্ছেদ হয়ে যায় ২০০৪ সালে।
ক্রিকেট ছাড়ার পর রাজনীতিতে জড়ানো ইমরান দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ সাংবাদিক-লেখক রেহাম খানকে। তবে সেই সংসারের স্থায়িত্ব ছিল এক বছরেরও কম। ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে বিয়ের পর অক্টোবরেই দুজন আলাদা হয়ে যান।
২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইমরান তৃতীয়বারের মতো বিয়ে করেন পাকিস্তানের আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা ও সুফি গুরু বুশরা বিবিকে। গুঞ্জন আছে, বুশরা বিবি নাকি স্বপ্নে দেখেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য ইমরানের একমাত্র উপায় হলো তাঁকে বিয়ে করা।
২০১৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় ইমরানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ। ওই বছর ১৮ আগস্ট পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন ইমরান। অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা হারান ২০২২ সালে।
Comments