প্রয়োজন ভারসাম্য পূর্ণ রাজস্ব নীতি

যখন আসন্ন অর্থবছরের জন্য জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করছে,তখন ব্যবসায়ী সমাজ থেকে যেসব উদ্বেগ আর পরামর্শ উঠে এসেছে সেগুলোকে গুরুত্ব দেয়ার তাগিদ এসেছে। কারণ এই ব্যবসায়ীরাই সিংহভাগ রাজস্ব যোগান দিয়ে থাকেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি এফবিসিসিআই-এর সাথে যে বাজেট পূর্ব আলোচনা করেছে সেখানে রাজস্ব আদায় সরকারের পিছিয়ে থাকাটাই বড় বিষয় হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৫ হাজার কোটি টাকা পিছিয়ে আছে রাজস্ব বিভাগ।
এই নিম্ন কর্মক্ষমতা বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) অন্যান্য শর্তের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য তার ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ প্যাকেজের বাকিটুকু প্রদান করতে রাজস্ব কর্মক্ষমতা উন্নত করার শর্ত দিয়ে রেখেছে। এখন সরকার এক উভয় সংকটে পড়েছে। একদিকে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কঠোর প্রবিধান চাওয়া এবং অন্যটি ব্যবসায়ী সম্প্রদায় থেকে করের বোঝা থেকে মুক্তির আহ্বান।
এনবিআর এবং এফবিসিসিআই আয়োজিত পরামর্শের সময়, টেক্সটাইল, গার্মেন্টস, ইস্পাত এবং এসএমই সেক্টরের ব্যবসায়ী নেতারা বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তারা জোর দিয়ে বলেন কীভাবে ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়, জ্বালানির দাম তাদের ব্যবসাকে ব্যহত করছে। সাথে আছে চিরাচরিত আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব এবং কঠোর কর নীতিমালা। এসব কারণে অনেক উদ্যোক্তাই নতুন বিনিয়োগ এবং ব্যবসা সম্প্রসারণে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি অভিযোগ করেছেন,শুল্ক কর্মকর্তারা বন্দরে পণ্য খালাসের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাঙ্ক গ্যারান্টি প্রকাশের জন্য ব্যবসায়িকদের ঘুষ দিতে বাধ্য করে। একইভাবে,স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমলাতান্ত্রিক অদক্ষতাকে বিনিয়োগের জন্য একটি প্রধান বাধা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। মেঘনা গ্রুপের চেয়ারম্যান কুমিল্লা ইপিজেডে তাদের ৬০০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন ইউটিলিটি সংযোগ পেতে দুই বছর বিলম্বের সেই জায়গা এখনও অব্যবহৃত।
ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের উদ্বেগগুলি ভিত্তিহীন নয়। নীতির ধারাবাহিকতা,হয়রানি হ্রাস এবং সাশ্রয়ী মূল্যের জ্বালানির জন্য তাদের কাতরতা কেবল সুবিধার জন্য অনুরোধ নয়, বরং শিল্প বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হিসেবে দেখতে হবে সরকারকে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক প্রতিবন্ধকতার মতো সমস্যাসমূহ শুধুমাত্র ব্যবসার খরচ বাড়ায় না বরং বিনিয়োগকারীদের আস্থা নষ্ট করে এবং দেশী ও বিদেশী উভয় পুঁজিকে বাধা দেয়।
বর্তমান করের চাপ থেকে অবকাশের জন্য,ব্যবসায়ী নেতারা ব্যক্তিদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানো,সমস্ত রপ্তানির উপর উৎস কর ০.৫০ শতাংশে কমিয়ে আনা এবং এসএমইকে সমর্থন করার জন্য স্থানীয় পণ্যের উপর একটি অভিন্ন কিন্তু কম ভ্যাট হার প্রতিষ্ঠা সহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের প্রস্তাব করেছেন। পরামর্শ সভায় উপস্থিত অর্থ উপদেষ্টা যথাযথভাবে উল্লেখ করেছেন যে দেশের ক্রমবর্ধমান রাজস্ব ঘাটতি এবং ঋণের বাধ্যবাধকতার কারণে উল্লেখযোগ্য কর সুবিধা দেয়া অসম্ভব। বাহ্যিক ঋণের বিকল্প কমে যাওয়া এবং উন্নয়ন অংশীদাররা শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংগ্রহের জন্য চাপ দিচ্ছে বিধায় সরকারের আর্থিক স্বাধীনতা একেবারেই সীমিত বলে জানান তিনি।
এ প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের সতর্ক অবস্থান বোধগম্য। এতে বলা হয়েছে, ব্যবসা করার সামগ্রিক সহজলভ্যতাকে উন্নত করতে সরকার বেসরকারি খাত যেসব প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করছে সেগুলো দূর করতে পারে।
বলতেই হবে সরকার একটি সূক্ষ্ম এবং জটিল ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতির মুখোমুখি। একটি হলো কঠোর রাজস্ব নীতি, অন্যদিকে নমনীয় অবস্থান। আসন্ন বাজেটে কাঠামোগত বাধা কমিয়ে এবং দুর্নীতি দমনের মাধ্যমে এই প্রজ্ঞার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। ব্যবসার উপর অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করার দক্ষতা রাজস্ব বিভাগকে অর্জন করতে হবে। এই ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতির মাধ্যমেই সরকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে পারে এবং জাতীয় উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ সুরক্ষিত করতে পারে।
Comments