তবে কি আমেরিকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল ইউক্রেন?

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন গত বুধবার একটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এই চুক্তিকে এমন একটা চুক্তি বলা হচ্ছে যার মাধ্যমে একটি দেশকে আসলে বিক্রি করে দেয়ার দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এই চুক্তি অনুযায়ী, এখন থেকে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ থেকে পাওয়া মুনাফার ৫০ ভাগের মালিক হবে আমেরিকা। এর কারণ হলো, এতদিন ধরে আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইউক্রেনের যুদ্ধে যে বিনিয়োগ করেছে, এর মাধ্যমে ইউক্রেন তা পূরণ করবে। ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত আমেরিকা ইউক্রেনে ১৮৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।
রাশিয়ার সাথে ইউক্রেনের যুদ্ধ আমেরিকার দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনার অংশ বলেই এখন প্রতীয়মাণ হচ্ছে। যুদ্ধ লাগিয়ে সেই যুদ্ধের খরচ তুলে নিচ্ছে ইউক্রেন থেকে। এই লক্ষ্যে থেকেই বছরের পর বছর ধরে আমেরিকা সেখানকার তরুণদের উজ্জীবিত করেছে। তরুণদেরকে এটা বুঝানো হয়েছে যে, ইউক্রেনের রাজনৈতিক দলগুলো দেশপ্রেমিক না। এরা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং এরা রাশিয়ার তাবেদার। রাশিয়া ইউক্রেনে লুটপাট করছে, রাশিয়া প্রভাব বিস্তার করছে – এসব বুঝিয়ে তরুণদেরকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে জাগিয়ে তোলা হয়েছে।
এই দীর্ঘ পরিকল্পনায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দশ বছরের মাথায় দেশটা দুটি বড় আন্দোলন দেখে। ২০০৪ সালের ওরেঞ্জ বিপ্লব এবং ২০১৪ সালের ইউরোমেইডেন। মূলত এই দুই আন্দোলনই ইউক্রেনের ইতিহাসকে বদলে দেয়। বিশেষ করে ২০১৪ সালের আন্দোলনকে বলা হয়, ইউরোপের বানানো পশ্চিমা ধাঁচের এমন এক আন্দোলন, যেখানে ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাব মুক্ত করার জন্য ইউরোপের কিছু দেশ এবং আমেরিকা দুই হাতে বিনিয়োগ করে। আন্দোলন চলাকালে পশ্চিমা নেতারা কিয়েভে গিয়েছিলেন, সমাবেশে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন।
তরুণদের ক্ষিপ্ত করতে তাদের গণতন্ত্র, সুশাসন, মানবাধিকার জাতীয় তাবিজ খাওয়ানো হয়। এনজিও ও সিভিল সোসাইটির মাধ্যমে বছরের পর বছর ধরে ক্রমাগত টাকাাপয়সা ঢালে মার্কিন যুতক্তরাষ্ট্র ও ইইউ। তিনটি এই অর্থ ঢালার সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। এরা হলো ইউএনএইড, ন্যাশনাল এনডাউমেন্ট ফর ডেমোক্র্যাসি এবং ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশন। এসব অর্থায়নের উদ্দেশ্য ছিল, কাগজে কলমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী দেখানো। কিন্তু বাস্তবে এসব প্রকল্প ইউক্রেনীয় তরুণদের মধ্যে পশ্চিমা ধ্যানধারণা ছড়িয়েছে। ফলে যখনই বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে, সেসব বিক্ষোভে হাজার হাজার তরুণ যোগ দিয়েছে। ফলে ২০১৪ সালে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানোকোভিচকে রাশিয়ায় পালিয়ে যেতে হয়।
এরকম করে তিন বছরের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির পর ২০১৯ সালে জেলোনস্কিকে ক্ষমতায় বসানো হয়। যার রাজনীতিতে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না; বরং উনি ছিলেন টেলিভিশনের এক কৌতুক অভিনেতা। এই কৌতুক অভিনেতার হাত ধরেই যে চুক্তিটা হলো, এর বিনিময়ে ইউক্রেনের মহামূল্যবান খনিজ সম্পদ এখন আমেরিকার। ইউক্রেনের যে সব স্বপ্নবান তরুণ সেসব আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল, তারা এখন প্রাণ বাঁচাতে ইউরোপের নানা দেশে পরিবারসহ উদ্বাস্তু।
ইউক্রেনের মাটির নিচে রয়েছে বহু মূল্যবান ক্রিটিক্যাল মিনারেল। এসব খনিজ পদার্থ আধুনিক প্রযুক্তি, সবুজ জ্বালানি এবং প্রতিরক্ষা শিল্পে অপরিহার্য। এর মধ্যে আছে, লিথিয়াম, যা ব্যাটারি উৎপাদনে অপরিহার্য। নিওডিমিয়াম, ওপ্রাসিওডিমিয়াম। এগুলা উইন্ড টারবাইন, ইলেকট্রিক মোটর ও ডিফেন্স টেকনোলজিতে ব্যবহৃত শক্তিশালী চুম্বক তৈরিতে দরকার। টাইটানিয়াম এভিয়েশন, ডিফেন্স, স্পেসক্রাফ্ট এবং চিকিৎসা যন্ত্রাংশে ব্যবহৃত হয়।
চীন বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রেয়ার আর্থ সাপ্লাই এর প্রধান সরবরাহকারী। সেই একচেটিয়াত্ব ভাঙতে ইউক্রেনকে কৌশলগতভাবে মূল্যবান মনে করা হয়। ইউক্রেনে প্রায় ১২,০০০টি খনিজস্থল চিহ্নিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ২০টি খনিজ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে স্বীকৃত।
ইউক্রেন আগাগোড়া এক কৃষি প্রধান দেশ। দুনিয়ার শস্যভাণ্ডারের অন্যতম যোগানদাতা হল ইউক্রেন। ইউরোপের সবচেয়ে বেশি আবাদযোগ্য জমিও কিন্তু এই ইউক্রেনেই। পৃথিবীর মহা গুরুত্বপূর্ণ মোট কালো মাটির ২৫ভাগ পাওয়া যায় এই দেশে যা গোটা ইউরোপের হিসেবে তৃতীয়।
সূর্যমুখী ও সেই থেকে উৎপাদিত তেল-উভয়ই রপ্তানিতে দুনিয়ার শীর্ষ দেশটার নাম হলো ইউক্রেন।
ভুট্টা দুনিয়াব্যাপি মহা গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যশস্য। উৎপাদনের দিক থেকে তৃতীয় আর রপ্তানির দিক থেকে চতুর্থ দেশটার নাম ইউক্রেন। দেশটি আলু উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ। জব উৎপাদনে সারা দুনিয়াব্যাপি পঞ্চম। মধু উৎপাদনেও দুনিয়ায় পঞ্চম স্থানে থাকা দেশের নাম ইউক্রেন। ২০২১ সালে এই দেশ একা ৩১.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন গম উৎপাদন করেছে। একইভাবে রপ্তানিতেও এই দেশ উপরের দিকে। বিশ্বে অষ্টম। মুরগীর ডিম উৎপাদনে সারা দুনিয়ায় নবম। পনির রপ্তানিতে সারা দুনিয়ায় ১৬ তম স্থান ইউক্রেনের।
শিল্পায়নেও ইউক্রেন কৃষির মতোই প্রাগ্রসর এক দেশ৷ স্টিল উৎপাদনে দুনিয়ায় দশম স্থান ইউক্রেনের। বছরে উৎপাদন করে সাড়ে ৩২ মিলিয়ন টন। নিরাপত্তা সরঞ্জাম উৎপাদনে সারা দুনিয়ায় ইউক্রেনের স্থান নবম। খনিজ রপ্তানিতে দুনিয়ায় অষ্টম। লোহাজাতীয় দ্রব্যাদি রপ্তানিতে সারা দুনিয়ায় চতুর্থ স্থান ইউক্রেনের। পলি রপ্তানিতে চতুর্থ। রকেট লঞ্চার উৎপাদনে এই দেশটা সারা দুনিয়ায় চতুর্থ। পরমাণু শক্তি উৎপাদন বিষয়ক স্থাপনা ও সরঞ্জাম বানানোর ক্ষেত্রে এই দেশের নাম চার নম্বরে আসে।
এখন থেকে ইউক্রেনের সব খনিজ সম্পদের অর্ধেকের মালিক আমেরিকা। তাহলে এই যুদ্ধ থেকে কী পেলো ইউক্রেন? পেলো, ৪৬০০০ মৃত সেনা, ১ লাখ ৮০ হাজার চিরতরে পঙ্গু সেনা, ১৩ হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যু, ঘরহারা লাখ লাখ পরিবার, ইউরোপ আমেরিকায় উদ্বাস্তু ইউক্রেনীয়ানদের ঢল, আর রাশিয়ার কাছে হারালো বেশ কিছু জায়গা।
Comments