ওসমানী মেডিকেল হাসপাতাল টাকা ছাড়া মেলে না শয্যা

সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগী ও তাঁদের স্বজনেরা পদে পদে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। কম খরচে ভালো চিকিৎসাসেবা পেতে গ্রামগঞ্জ থেকে আসা সরল রোগী ও তাঁদের স্বজনদের পড়েতে হয় বিড়ম্বনায়। হাসাপাতালের ওয়ার্ডবয়কে টাকা দিলে মিলে ভালো আচরণ ও বেড। টাকা নাই তো ভালো আচরণও নাই, বেডও নাই। বেড থাকা সত্ত্বেও রোগীদের থাকতে হয় ফ্লোরে। বিছনার চাদরও বদল হয়না এক সপ্তাহে।
এছাড়াও হাসপাতালে ব্রাদার ও নার্সরা বেড নিয়ে বাণিজ্য করেন। ভর্তি হতে আসা রোগীদের কাছে বেড সঙ্কটের কথা জানিয়ে দেয়া হয়। বেড খালি থাকলেও তাদের দেয়া হয় না। পরে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা চকচকে নোট হাতে ধরিয়ে দিলেই তাদের বেড দেয়া হয়, করা হয় ভালো আচরণ। এখানেই শেষ বেডে থাকতে হলে প্রতিদিন টাকা পরিশোধ করতে হয় রোগীদের স্বজনদের।
ইমার্জেন্সি বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীদের পড়তে হয় আরও বিড়ম্বনায়। রোগী বহনের ক্ষেত্রে ট্রলি মিলে না প্রায় সময়। ট্রলি বহনকারী কর্মচারীরা রোগী আনা-নেয়ার জন্য মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করেন। টাকা দিলে ট্রলি মিলে অন্যথায় রোগীদের স্বজনদের কাঁধে ভর দিয়ে চলতে হয়। এর বাইরে ওষুধ, স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও রক্ত জোগাড় করতে হলেও রোগীদের স্বজনদের পদে পদে ভোগান্তি পোহাতে হয়।
গত শনিবার (১৫ মার্চ) সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আউটডোর ও ওয়ার্ডে অবস্থান করে এমন চিত্র দেখা গেছে।

হাসপাতাল সূত্র বলছে, ৯০০ শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালে ৫০০ শয্যার সুযোগ-সুবিধা আছে। তবে হাসপাতালটিতে প্রতিদিন সিলেট ও আশেপাশের জেলাগুলো থেকে প্রায় আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী সেবা নেন। জরুরি ও বহির্বিভাগ মিলিয়ে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা সেবা নেন ৪ হাজারের অধিক রোগী। শনিবার বেলা সাড়ে ১২টায় ওসমানী হাসপাতালের আউটডোর এর চর্মরোগ বিভাগে গিয়ে দেখা গেল একজন বয়োবৃদ্ধ পুরুষ দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। জানা গেল ভেতরে চিকিৎসকও আছেন। উকি দিয়ে দেখা গেল তিনি চেম্বারে বসে খোশগল্প করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানালেন তিনি সুনামগঞ্জ থেকে এসছেন। তিনি বলেন আধাঘণ্টা ধরে এখানে দাড়িয়ে আছি। ডাক্তারের এটেনডেন্ট বলেছেন স্যার ব্যস্ত, যখন ডাকবেন তখন দেখবেন। এমন চিত্র মেডিসিন বিভাগেও দেখা গেল। জগন্নাথপুর থেকে চিকিৎসা নিতে আসা ষাটোর্ধ এক নারী শ্বাসকষ্টে ছটফট করছেন। তাঁর স্বজন জানান। একঘন্টা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। স্যার চেম্বারে নেই। বাহিরে গেছেন। এলে রোগী দেখবেন। হাসপাতালের পুরো বহির্বিভাগেই এমন দুরবস্থা বিরাজমান।
তথ্য বলছে, এ বহির্বিভাগে গড়ে প্রতিদিন দুই থেকে আড়াই হাজার রোগী ডাক্তার দেখিয়ে থাকেন। সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সহজ সরল এই গরিব মানুষগুলো ভোরে রওয়ানা দিয়ে সরকারি চিকিৎসক দেখানোর জন্য শহরে এসে পড়েন নানা ভোগান্তিতে। প্রথমে টিকেটের জন্য তাদের দাঁড়াতে হয় লম্বা লাইনে। এরপর ডাক্তারের কক্ষের সামনে লম্বা লাইন। কোনোভাবে ডাক্তার দেখানো গেলেও ওষুধ নিতে গিয়েও লাইন। একই অবস্থা হাসপাতালের ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা রোগীদের বেলায়ও। চিকিৎসা নিতে এস যেন পদে পদে রোগীর স্বজনদের ভোগান্তির শিকার হতে হয়।
অভিযোগ রয়েছ, রোগীদের হয়রানি ও টাকা ছাড়া চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা কাজ করেন না। অন্যদিকে চিকিৎসকদের গাফিলতি এসব অভিযোগ সর্ম্পকিত প্রশ্নের জবাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দেখান নানা যুক্তি। আছে জনবল সংকটের দোহাই। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, হাসপাতালে বেডের সংখ্যা ৫০০। আর চিকিৎসার ওষুধ ও খাবারের আয়োজন রয়েছে ৯০০ রোগীর। এ কারণে যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারা সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
অন্যদিকে হাসপাতালের অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকদের সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে দেখা যায়। আর বাকি সময় তারা বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। ফলে তাদের কাছ থেকে সঠিক সেবা পায় না রোগীরা।
সূত্র জানায়, হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগে রোগ নির্ণয়ের সব সরঞ্জাম থাকলেও অধিকাংশ সময় সেগুলো অকেজো বলে জানিয়ে দেয়া হয়। রোগীদের কৌশলে নিজেদের প্যাথলজি সেন্টারে নিয়ে যায় দাললেরা। কখনও কখনও ডাক্তার ও নার্সরা তাদের নির্ধারিত প্যাথলজি সেন্টারে রোগীদের পাঠিয়ে দেন। আর গাইনি ওয়ার্ডে ভর্তি হলেই দেয়া হয় একাধিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষাগুলো আবার হাসপাতালে করা হয় না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হাসপাতালে রক্ত সিন্ডিকেট এখন আরো তৎপর। রক্তের মজুদ থাকলেও রক্ত না বলে জানানো হয় প্রায়ই। ফলে বাধ্য হয়ে বাইরে থেকে পরীক্ষা ছাড়াই রক্ত নিয়ে আসেন রোগীর স্বজনরা। বেশির ভাগ রোগীর বেলায় রক্ত না ব্যবহার হলেও এসব রক্ত চোরাই পথে আবার নিয়ে যাওয়া হয় ওইসব প্যাথলজি সেন্টারে।
হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এসব ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। অপারেশন থিয়েটার ও ওষুধ নিয়ে চলছে রমরমা বাণিজ্য। রোগীর সার্জারি সরঞ্জামাদি দিগুণ লিখে দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও হাসপাতালের বাইরে থাকা ফার্মেসিগুলোর নিয়োজিত দালালদের দৌরাত্ম্য কমছে না। বরং দিন দিন আরো বাড়ছে।
হাসপাতালের উপপরিচালক (প্রশাসন) ডা. সৌমিত্র চক্রবর্তী বলেন, বেশির ভাগ অভিযোগ ঠিক নয়। তবে অনেকেই হাসপাতালের সব কিছু জানেন না। এ কারণে তারা একশ্রেণির দালাল এর হাতে প্রতারিত হচ্ছেন। কছুদিন পরপরই হাসপাতালের দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়।
Comments