পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের উপযুক্ত সময় এখনই
২০২৪ সালে দেশের পুঁজিবাজার মন্দা সময় পার করেছে। অনেক বিনিয়োগকারী বছরটিকে হতাশাজনক হিসেবে অভিহিত করেছেন। কারণ গত এক বছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচক বড় ধরনের পতনের কবলে পড়ে। বাজার মূলধন, গড় দৈনিক লেনদেন অনেক কমে গেছে। কোনো উল্লেখযোগ্য কোম্পানিও বাজারে প্রবেশ করেনি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বেঞ্চমার্ক সূচক ডিএসইএক্স গত এক বছরে ১৬ শতাংশ কমেছে। ১ জানুয়ারি, ২০২৪ তারিখে ডিএসইএক্স সূচকের অবস্থান ছিল ৬ হাজার ২৪২ দশমিক ৮৭ পয়েন্টে। বছরের শেষ কার্যদিবস ৩০ ডিসেম্বর এর অবস্থান দাঁড়ায় ৫ হাজার ২১৬ দশমিক ৪৪ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক বছরে সূচকটির অবস্থান ১ হাজার ২৬ পয়েন্ট কমে গেছে। বাজার মূলধন কমেছে এক লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা। অপর দুই সূচকেরও বড় পতন হয়েছে। দৈনিক লেনদেনের পরিমাণ ৫শ' কোটি থেকে ৩শ' কোটির ঘরে নেমেছে।
করোনাভাইরাস মহামারি পরবর্তী সময়ে এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের দীর্ঘস্থায়ী ফলাফলের কারণে পুঁজিবাজারে বছরজুড়ে অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। হতাশাগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের দাবির প্রেক্ষিতে ২০২২ সালে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সূচকের অবাধ পতন রোধ করার জন্য প্রতিটি শেয়ারে ফ্লোর প্রাইস নির্ধারণ করে দেয়। যা ছিল একটি শেয়ারের সর্বনিম্ন দাম। এর নিচে শেয়ার দর আর নামতে পারবে না।
ফ্লোর প্রাইস সাধারণত কোন সেবা বা পণ্যের সরকার নির্ধারিত দাম, যা ওই পণ্যের ভারসাম্য বা ভারসমতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। যার দাম নিচে নামতে না পারলেও ওপরে ওঠার বিস্তর সুযোগ থাকে। ফ্লোর প্রাইজ আরোপের পর ২০২৩ সালে এসব শেয়ারের দর ফ্লোর প্রাইসেই আটকে থাকে। বাজার তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিএসইসি ও ডিএসই'র গুরুত্বপূর্ণ পদে পরিবর্তন আনা হয়। সেই সাথে ফ্লোর প্রাইস মেকানিজমও প্রত্যাহার করা হয়। এ সময় অল্প কিছুদিন বাজার কৃত্রিমভাবে প্রসারিত হওয়ার পরিবর্তে বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। কিন্তু বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থার ঘাটতি রয়েই যায়।
দীর্ঘস্থায়ী মন্দা প্রবণতার কারণে গত চার অর্থবছরে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যাও অর্ধেকের বেশি কমে গেছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ডিএসই-ইনভেস্টরের মোবাইল ও ডেস্কটপ সংস্করণের নিবন্ধিত ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৯০০ জনে। এই সংখ্যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ২৯ শতাংশ কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরে অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪৬ হাজার ৬২২ জন। বর্তমান ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২০২২ অর্থবছরের সঙ্গে তুলনা করা হলে ৪০ শতাংশ কম। ২০২২ অর্থবছরে অ্যাপ ব্যবহারকারী ছিল ৭৭ হাজার ৯৪৯ জন।
শুধু মোবাইল অ্যাপ ব্যবহারকারীর সংখ্যাই নয়, বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) অ্যাকাউন্টের সংখ্যাও কমে যাচ্ছে। এ থেকে বোঝা যায়, মানুষ বাজার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এদিকে টার্নওভার বা মোট লেনদেনেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। ২০২৪ অর্থবছরে টার্নওভার আগের বছরের চেয়ে ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ কমে ২১ হাজার ১৫৫ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
সাধারণত ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা প্রাথমিক পাবলিক অফারিং (আইপিও) এর মাধ্যমে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ শুরু করেন। আইপিও'র মাধ্যমে সামান্য অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হন। কিন্তু গত এক বছরে আইপিওতে মাত্র চার কোম্পানি বাজারে এসেছে। যেখানে ২০২৩ সালে এসেছিল মাত্র তিনটি। যা ছিল গত প্রায় দুই দশকের মধ্যে সর্বনিম্ন। আমাদের দেশের বাজারের প্রধান সমস্যাই বিনিয়োগ উপযোগী শেয়ারের অভাব। অভ্যুত্থানের পর, বাজার কিছুটা গতি লাভ করলেও দুর্ভাগ্যবশত: আত্মবিশ্বাসের অভাবে বাজার তার সেই গতি ধরে রাখতে পারেনি। অন্তর্বর্তী সরকার যদি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে চান, তাহলে পুঁজিবাজারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি ভালো পারফরম্যান্স দেখানো কোম্পানিগুলোকে বাজারে আনতে হবে। শুধু নীতিগত পরিবর্তন এনে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো যাবে না। ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত করতে পারলে বাজার মূলধন বাড়বে। কোম্পানিগুলো প্রতি বছর ভালোমানের লভ্যাংশ দিলে বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের ফল দেখতে পারবেন। দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগে আস্থা আসবে। তাহলেই পুঁজিবাজার তার কাঙ্ক্ষিত গতি ফিরে পাবে।
পুঁজিবাজারে পতনের সাথে সাথে বাজারের মূল্য-আয় অনুপাত (পিই রেশিও) ৯.৫০ এ দাঁড়িয়েছে। যেখানে আগের বছর এটি ছিল ১৩.১২। পিই রেশিও যত কম, বাজার ততই বিনিয়োগ উপযোগী। বর্তমান পিই রেশিও বিনিয়োগ উপযোগী সময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে। শেয়ারের দাম কম থাকায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের এটাই উত্তম সময়। পুঁজিবাজারে কখন বিনিয়োগ করতে হয় এটা ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারলেই তাদের আর পুঁজি হারিয়ে নি:স্ব হতে হবে না। বাজার নিয়ে হতাশাও কমবে। নতুন বছরে বিনিয়োগকারীরা সচেতনতার সাথে বিনিয়োগ করে পুঁজিবাজারকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাক এটাই বাজার সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা।