যশোরের চৌগাছা থানার বিতর্কিত ওসি পায়েলের অশালীন ভিডিও ভাইরাল
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে ঢাকার রমনা থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পায়েল হোসেনের অশ্লীল ভিডিও। যশোরের চৌগাছা থানায় ওসি হিসেবে যোগদানের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে টর্চার সেল, রিমান্ড বাণিজ্য, চাঁদাবাজি সহ বহু বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের লিপ্ত হয়ে তুমুল সমালোচিত হয়ে উঠেছিলেন এ ওসি। এরই মধ্যে শনিবার চৌগাছা এলাকার এক ডিভোর্সি নারীর সাথে অশালীন অঙ্গভঙ্গিতে কথা বলা ও শরীরের গোপনাঙ্গ প্রদর্শনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
ঢাকা জার্নালের হাতে আসা ওই ভিডিওতে দেখা যায় এক নারীর সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলছেন ওসি পায়েল হোসেন। কথা বলতে বলতে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করতে দেখা যায় তাকে। এক পর্যায়ে ওই নারীকে নিজের শরীরের স্পর্শকাতর বিভিন্ন গোপন জায়গা দেখাচ্ছেন আর হাসছেন তিনি।
৫ মিনিট ১৩ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি পায়েল হোসেন হাসতে হাসতে ওই নারীকে বিভিন্নভাবে অশালীন ইঙ্গিত দিচ্ছেন। এক পর্যায়ে নিজের পুরো শরীর প্রদর্শন করতেও দেখা যায় তাকে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার চৌগাছা থানা এলাকায় তার টর্চার সেল, চাঁদাবাজি ও রিমান্ড বাণিজ্য সম্পর্কে অনুসন্ধানে গেলে তার প্রমাণ মেলে। এ বিষয়ে ওসির সাথে কথা বলতে চাইলে ঢাকা জার্নালের প্রতিনিধির সাথে দেখা না করে মুঠোফোনে দাম্ভিকতা দেখান ওসি পায়েল। তিনি সাংবাদিকতাও শেখান সেদিন।
শনিবার ভিডিওর সাথে ওই নারীকে কু প্রস্তাব দেয়ার তিনটি অডিও ক্লিপও আসে ঢাকা জার্নালের হাতে। যেখানে তার সাথে রাত্রিযাপন করতে ৫ হাজার টাকার দেখানো হয়। আরেকটি অডিওতে ওই নারীকে চুমু খেতে শুনা যায় ওসি পায়েলকে।
অনুসন্ধানে মিলিছে, কিছুদিন আগে চৌগাছা উপজেলায় পারিবারিক বিরোধের জেরে এক নারীর সঙ্গে তার স্বামীর বিচ্ছেদ হয়। সেই নারীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার সঙ্গে রাত্রিযাপন সহ বিভিন্ন কুপ্রস্তাব দেন ওসি। কিন্তু ওই নারী রাজি না হওয়ায় তাকে দেহ ব্যবসায়ী বলে মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর ভয় দেখান ওসি।
ওসির সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে ওই নারী বলেন, ডিভোর্স সংক্রান্ত বিবাদ মিমাংসার জন্য সাবেক স্বামীর সাথে থানায় যান ওই নারী । তিনি দ্বিতীয় দফা তারিখ দিলে ওই নারী থানায় গেলে বাথরুমের মধ্যে নিয়ে তাকে চুমু দেয় ওসি। তারপর থেকে ফোনে ওই নারীকে কুপ্রস্তাব দেয়া শুরু করেন ওসি । এতে রাজি না হওয়ায় তার ভাইকে ধরে মিথ্য মামলায় চালানও করেন। এরপর ওই নারীকে দেহ ব্যবসায়ী বলে চালান দেয়ার ভয় দেখিয়ে ভিডিও কলে কথা বলতে বাধ্য করেন এবং নিজের শরীরের স্পর্শকাতর জায়গা ওই নারীকে দেখাতে থাকেন এবং তার বাংলোতে রাত্রিযাপনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। এরই মধ্যে ওই ভিডিও ও অডিও কলের ক্লিপগুলি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতায় বর্তমানে চৌগাছা ছেড়ে অনত্র আশ্রয় নিয়েছেন ওই নারী।
গত সেপ্টেম্বর মাসে পায়েল হোসেন ঢাকার রমনা থানা থেকে বদলি হয়ে চৌগাছা থানার ওসির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। থানায় যোগদানের পর থেকেই টাকার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন তিনি। চৌগাছা এলাকায় চাউর রয়েছে পুলিশের এক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাকে চল্লিশ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি ওসির চেয়ারে বসেছেন । এ টাকা তুলতে যা যা করার সবই তিনি করবেন।প্রথম অভিযানেই তিনি চৌগাছা বাস মালিক সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিনের বাড়ি সারারাত অবরুদ্ধ করে রাখেন। পরের দিন সকালে জসিম উদ্দিনের স্কুল পড়ুয়া ছেলে বার্ষিক পরীক্ষা দিতে বাড়ির বাইরে গেলে থানার পুলিশ সদস্যরা তার গাড়ি আটক করে তল্লাশি শুরু করে। এসময় স্থানীয়রা জড়ো হয়ে ছেলেটির পরীক্ষার কথা বার বার বলতে থাকলেও প্রায় ৪৫ মিনিট সেই গাড়ি তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করে তবেই তাকে যেতে দেয়। এরপরে ওসি জসিম উদ্দিনের কাছে ১ কোটি টাকা দাবি করেছিলেন বলে জসিম উদ্দিন জানিয়েছেন। এরপর ভাদড়া গ্রামের বিএনপি নেতা ব্যবসায়ী মানিক হোসেনেকে আটক করে থানায় এনে হাজতে না রেখে নিজ বাংলোর একটি কক্ষে আটকে রেখে গোপনাঙ্গে ইলেক্ট্রিক শক ও শারীরিক নির্যাতন করতে থাকেন । এবং ফোন করে মানিকের স্ত্রীর তোহরা খাতুনের কাছে শুধু মার বন্ধ করতে পাঁচলক্ষ টাকা দাবি করে তা আদায়ও করেন। পরে অস্ত্র মামলা ও রিমান্ড আবেদন করে তাকে আদালতে সোপর্দ করেন। এছাড়াও মাসিলা গ্রামের পারভেজ আহমেদ সোহাগ নামে এক যুবককে তুলে এনে দুই লক্ষ টাকা দাবি করে ৩২ ঘন্টা তার টর্চার সেলে আটকে রেখে ইলেক্ট্রিক শক ও শারীরিক নির্যাতন চালান এবং ফোন করে তার মা কে আহজারি শোণান । শেষমেশ সোহাগের মা দেড় লক্ষ টাকা দিতে রাজি হন কিন্তু অনেকটা একদরের দোকানের মত পায়েলের অবস্থান অনড় থাকে অবশেষে তাকে ডাকাতি, ছিনতাই ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের বিভিন্ন সময়ের মামলায় আসামি দেখিয়ে তাকে আদালতে সোপর্দ করে রিমান্ড আবেদন করেন। গত এক সপ্তাহে এ দুটি লোমহর্ষক ঘটনা এলাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে । অনেক পরিবারের পুরুষেরা ইতিমধ্যে রাতে বাড়ী ছেড়ে অন্যত্র রাত্রিযাপন করছেন।
এরআগে ২৩ নভেম্বর সিংহঝুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হামিদ মল্লিককে গ্রেপ্তার করে ওই টর্চার সেলে ছয় ঘন্টা আটকে রেখে ১০ লক্ষ টাকা দাবি করেছিলেন। চেয়ারম্যান টাকা দিতে অস্বীকার করলে তাকে ২০১৯ সালের একটি চাঁদাবাজির মামলায় আদালতে প্রেরণ করা হয়। ২ দিনপর হামিদ মল্লিক জামিনে বেরিয়ে গ্রেপ্তারের সময় থানায় জমা রাখা তার মোবাইল ফোনসহ অন্যান্য জিনিসপত্র আনতে গেলে ওসি পায়েল তাকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। ওই মামলার বাদী একই উপজেলার চাড়াবাড়ি গ্রামের নান্নু মিয়া তার মামলায় হামিদ মল্লিকের মত একজন স্বজ্জন ব্যক্তিকে আসামি করায় বারবার হামিদ মল্লিকের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন নিরাপরাধ ব্যক্তি হয়রানি ও পুলিশের বাণিজ্য বন্ধে তিনি মামলাটিই তুলে নিবেন।
চৌগাছা বাজারের আরেক ব্যবসায়ী জীবন হোসেন লিপু গেল ১৭ ডিসেম্বর তার বন্ধু বাবুলের ছোট ভাই হারিয়ে গেলে থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। ২ দিন পর ওসি বাবুল কে ডেকে বলেন তাকে নরসিংদিতে পাওয়া গেছে ওখান থেকে আনতে হলে এডিশনাল এসপিকে টাকা দিতে হবে,বিভিন্ন খরচ আছে বলে দুই লক্ষ টাকা দাবি করেন । নিরুপায় হয়ে বাবুল গরু বিক্রি করে ৪০ হাজার টাকা ও তার বন্ধু জীবন হোসেন লিপুর কাছে থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে মোট ৫০ হাজার টাকা ওসির হাতে তুলে দেন। পরদিন তাদের স্বজনরাই হারনো ব্যক্তিকে উদ্ধার করতে সমর্থ হলে ওসির কাছে টাকা ফেরত চান তারা। এ সময় ওসি তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করলে তারা এসপির কাছে অভিযোগ করার কথা জানালে ওসি আরও রেগে যান । তিনি বলেন তোরা থানায়ই ঢুকতে পারবিনা সে ব্যবস্থ্যা করছি । তারপর 'দালাল হইতে সাবধান' লিখে বাবুল ও জীবনের ছবি ও ফোন নং সম্বলিত পোস্টার থানার দেয়াল ও প্রাচীরে লটকে দেন ওসি ।
এরপর মুঠোফোনে জীবনকে গুলি করার হুমকি সহ নানা ধরনের ভয়ভীতি দেখাতে থাকেন।বাধ্য হয়ে জীবন এবং বাবুল প্রাণভয়ে চৌগাছা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। এ কল রেকর্ডটিও ঢাকা জার্নালের কাছে পৌঁছেছে।
এছাড়া উপজেলায় মাদক ব্যবসা, অবৈধ বালু উত্তোলন, ইটভাটার মাটি কাটার চুক্তিসহ নানান অপকর্মের চুক্তি সরাসরি ওসির সঙ্গেই করতে হতো। অন্য কোনো পুলিশ সদস্যে এসবের বাইরে গেলে তাকে ভৎসনার শিকার হতে হতো ।
সব অভিযোগ অস্বীকার করলেও নারীর সাথে ভিডিও কলের ব্যাপারে ওসি পায়েল হোসেন ঢাকা জার্নালকে বলেন , ওই নারী বিচার চাইতে এসেছিলেন, সে নিজেই ভিডিও কল দিয়েছিলো এটা ষড়যন্ত্র বলে দাবি করেন তিনি। তার অশালিন অঙ্গভঙ্গি ও শরীরের স্পর্শকাতরস্থান দেখানোর ব্যাপারে জানতে চাইলে ওসি বলেন "ভাই আমাকে বাঁচান, ওই মহিলা আমাকে ট্রাফে ফেলেছে, আমাকে হেল্প করেন।" তারপর বিভিন্নভাবে ম্যানেজের চেষ্টাও করেন ওসি।
যশোরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর-ই-আলম সিদ্দিকী ঢাকা জার্নালকে জানিয়েছেন, কোন ভুক্তভোগী যদি সুনির্দিষ্ট কোনও অভিযোগ করে তাহলে বিভাগীয় ও আইনানুগ ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে সকল ব্যাপারে খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে। প্রমাণ মিললেই বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থ্যা গ্রহণ করা হবে । একই সাথে কোনও পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে এ ধরণের হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষনিক জেলা পুলিশকে জানানোর আহ্বান জানান তিনি।